অর্ডিনারি আইটির পোস্ট নোটিফিকেশন


জাতীয়তাবাদ, জাতি ও রাষ্ট্র - Nationality Nation and State | একাদশ শ্রেণী রাষ্ট্রবিজ্ঞান

জাতীয়তাবাদ, জাতি ও রাষ্ট্র - Nationality Nation and State PDF: প্রতিবছর বিভিন্ন সরকারি চাকরির পরীক্ষায় একাদশ শ্রেণী রাষ্ট্রবিজ্ঞান জাতীয়তাবাদ, জাতি ও রাষ্ট্র - Nationality Nation and State PDF থেকে অনেক প্রশ্ন আসে। তাই আমরা আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছি জাতীয়তাবাদ, জাতি ও রাষ্ট্র - Nationality Nation and State PDF

জাতীয়তাবাদ, জাতি ও রাষ্ট্র - Nationality Nation and State | একাদশ শ্রেণী রাষ্ট্রবিজ্ঞান

নিচে জাতীয়তাবাদ, জাতি ও রাষ্ট্র - Nationality Nation and State PDF টি যত্নসহকারে পড়ুন ও জ্ঞানভাণ্ডার বৃদ্ধি করুন। জাতীয়তাবাদ, জাতি ও রাষ্ট্র - Nationality Nation and State PDF টি সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ডাউনলোড করতে এই পোস্টটির নীচে যান এবং ডাউনলোড করুন।


জাতীয়তাবাদ, জাতি ও রাষ্ট্র - Nationality Nation and State | একাদশ শ্রেণী রাষ্ট্রবিজ্ঞান


জাতীয়তাবাদ, জাতি ও রাষ্ট্র - Nationality Nation and State PDF

Dear Students, Gksolves.com চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতির সেরা ঠিকানা, আজ আমরা আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছি জাতীয়তাবাদ, জাতি ও রাষ্ট্র - Nationality Nation and State PDF. প্রতিবছর বিভিন্ন সরকারি চাকরির যেমন Railway Group D | PSC Clerkship | WBCS | SSC CHSL | SSC CGL | SSC MTS | WBP Abgari Constable | WBP SI | WBP Constable | ICDS Supervisor | Railway Group D | RRB NTPC | PSC Miscellaneous | TET  | Upper Primary  | Group D ইত্যাদি পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ হয়ে থাকে। এই সমস্ত চাকরির পরীক্ষা ছাড়াও মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক সম্বন্ধে আপনার সাধারণ ধারণা থাকা দরকার, তাই আমরা আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছি জাতীয়তাবাদ, জাতি ও রাষ্ট্র - Nationality Nation and State PDF যা আপনাদের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সম্পর্কে ধারণা গঠন করতে বিশেষ সাহায্য করবে। 



Google News এ আমাদের ফলো করুন


Gksolves Google News


জাতীয়তাবাদ, জাতি ও রাষ্ট্র - Nationality Nation and State | একাদশ শ্রেণী রাষ্ট্রবিজ্ঞান


জাতীয়তাবাদ, জাতি ও রাষ্ট্র - Nationality Nation and State


সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর

প্রশ্ন ১। আন্তর্জাতিকতাবাদ কাকে বলে?

উত্তর: বিশ্বের বিভিন্ন জাতিগুলি পারস্পরিক অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এক বিস্তৃত আনুগত্যবােধের মধ্য দিয়ে যে বিশ্ব ভ্রাতৃত্ববােধ গড়ে তােলে, তাকে আন্তর্জাতিকতাবাদ বলে। গােল্ডস্মিথের মতে, A Feeling that the individual is a citizen of the world.


প্রশ্ন ২। এক জাতি এক রাষ্ট্র বলতে কী বােঝ?

উত্তর: প্রতিটি জাতির জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের নীতিকে এক জাতি এক রাষ্ট্র বা আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বলে (One Nation-One State)।


প্রশ্ন ৩। ‘জাতীয়তাবাদ’ বলতে কী বােঝায়?

উত্তর: ‘জাতীয়তাবাদ’ বলতে একটি ভাবগত ও মানসিক ধারণাকে বােঝায়। জাতীয়তাবাদ হল জনসমাজের মধ্যে এক গভীর ঐক্যবােধ বা স্বাতন্ত্র্যবােধ। কোনাে জনসমাজ ভাবগত ঐক্যবােধের ভিত্তিতে একাত্ম হলে এবং নিজেদের স্বতন্ত্রসত্তা সম্বন্ধে সচেতন হলে জাতীয়তাবােধের সৃষ্টি হয়।


প্রশ্ন ৪। জাতীয় জনসমাজ কাকে বলে?

উত্তর: ‘জাতীয় জনসমাজ’ হল একটি নির্দিষ্ট ভৌগােলিক সীমার মধ্যে বসবাসকারী এমন এক জনসমাজ যাদের মধ্যে বংশ, ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি প্রভৃতি ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য ও বিভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও ইতিহাসগত ও রাজনৈতিক স্মৃতিগত এক দৃঢ় ঐক্যের বন্ধন গড়ে উঠেছে এবং যারা অন্যান্য জনসমাজ থেকে নিজেদের স্বতন্ত্র বলে মনে করে।


প্রশ্ন ৫। জনসমাজ ও জাতীয় জনসমাজের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?

উত্তর: জনসমাজ ও জাতীয় জনসমাজের মধ্যে পার্থক্য হল এই যে, জনসমাজের মধ্যে রাষ্ট্রনৈতিক চেতনা জাগ্রত হলে তা জাতীয় জনসমাজে পরিণত হয়। জাতীয় জনসমাজকে রাষ্ট্রনৈতিক চেতনাসম্পন্ন জনসমাজ বলে গণ্য করা যায়।


প্রশ্ন ৬। আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে লেনিনের বক্তব্য কী?

উত্তর : লেনিন জাতিগত সমস্যাকে শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবের সঙ্গে সংযুক্ত করেন। সাম্রাজ্যবাদীর বিরুদ্ধে পরাধীন জাতিগুলির মুক্তি আন্দোলন হল গণতান্ত্রিক আন্দোলন। এর ফলে শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে আন্তর্জাতিকতাবাদ সৃষ্টি হবে।


প্রশ্ন ৭। জাতি কাকে বলে?

উত্তর: স্বাধীন রাষ্ট্রে বসবাসকারী অথবা স্বাধীনতার জন্য সচেষ্ট রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ জনসমাজকে জাতি বলে। রাষ্টবিজ্ঞানী বার্জেস বলেছেন, “পরস্পর সন্নিহিত কোনাে ভৌগােলিক অঞ্চলের বসবাসকারী এক জনসমাজ যদি একই ভাষা ও সাহিত্য, একই ইতিহাস ও ঐতিহ্য, একই আচার-ব্যবহার, একই ধরনের ন্যায়-অন্যায় ও সুখ-দুঃখের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয় তখন তাকে জাতি বলে।


প্রশ্ন ৮। জাতি ও জাতীয় জনসমাজের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?

উত্তর: জাতি ও জাতীয় জনসমাজের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করেছেন লর্ড ব্রাইস। জাতীয় জনসমাজ হল ভাষা, সাহিত্য, ধ্যানধারণা, রীতিনীতি ও ঐতিহ্য প্রভৃতির বন্ধনে ঐক্যবদ্ধ এমন একটি জনসমষ্টি যা অনুরূপভাবে ঐক্যবদ্ধ জনসমষ্টি থেকে নিজেকে পৃথক বলে মনে করে না। অপরদিকে জাতি হল রাষ্ট্রনৈতিকভাবে সংগঠিত এক জনসমাজ যা বহিঃশােষণ থেকে মুক্ত হবার চেষ্টা করছে।


প্রশ্ন ৯। আন্তর্জাতিকতাবাদ’ বলতে কী বােঝ?

উত্তর: আন্তর্জাতিকতাবাদ হল একটি ভাবগত বা মানসিক অনুভূতি। এই অনুভূতির জন্য ব্যক্তি নিজেকে নিজ রাষ্ট্রের নাগরিক ভাবার পাশাপাশি বিশ্ব নাগরিক হিসাবেও নিজেকে ভাবতে শেখে। এর মূল উদ্দেশ্য হল সাম্য ও সহযােগিতার ভিত্তিতে এক প্রীতিপূর্ণ বিশ্বসমাজের প্রতিষ্ঠা।


প্রশ্ন ১০। জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নীতির কয়েকজন প্রবক্তার নাম লেখাে।

উত্তর: জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নীতির কয়েকজন প্রবক্তা হলেন প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন, বিখ্যাত ইংরেজ দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিল, মার্কসবাদী তাত্ত্বিক লেনিন ও স্তালিন।


প্রশ্ন ১১। জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের সপক্ষে চারটি যুক্তি দাও।

উত্তর: (ক) প্রতিটি জাতিরই নিজস্ব মৌলিক বৈশিষ্ট্যের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের জন্য জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের স্বীকৃতি প্রয়ােজন।

(খ) জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের নীতি স্বীকৃত হলে সরকার জনগণের সব অংশের সমর্থনের ভিত্তিতে ক্ষমতাসীন হয়। এর ফলে জনগণ স্বেচ্ছায় আইন মেনে চলে।

(গ) আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নীতিটি জাতীয় গুণাবলির বিকাশে সহায়ক।

(ঘ) ব্যক্তিস্বাধীনতার স্বার্থে এই অধিকারের স্বীকৃতি প্রয়ােজন।


প্রশ্ন ১২। জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের বিপক্ষে দুটি যুক্তি দাও।

উত্তর: (ক) এই নীতি কার্যকর করতে গেলে বহুরাষ্ট্রকে ভেঙে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

(খ) বহু জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র গঠিত হলেই যে জাতিগত বিরােধ বা সংঘর্ষের সম্ভাবনা থাকবে না, একথা জোর দিয়ে বলা যায় না।


প্রশ্ন ১৩। আন্তর্জাতিক রাজনীতি কাকে বলে?

উত্তর: মরগেনথাউ-এর মতে, আন্তর্জাতিক রাজনীতি হল মূলত ক্ষমতার লড়াই। কয়েকজন লেখকের মতে, আন্তর্জাতিক রাজনীতি মূলত বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে শক্তিগত সংঘর্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে আলােচনা করে। আবার কেউ কেউ মনে করেন যে, আন্তর্জাতিক রাজনীতি মূলত আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলােচনা করে।


প্রশ্ন ১৪। ‘জনসমাজ’ বলতে কী বােঝায়?

উত্তর: সংকীর্ণ অর্থে জনসমাজ’ বলতে বােঝায় সেই জনসমষ্টিকে যারা একই ভূখণ্ডে বসবাস করে, যাদের ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস, আচার-আচরণ অভিন্ন এবং যাদের অধিকারবােধ ও অভিযােগে ঐক্যের সন্ধান পাওয়া যায়। ব্যাপক অর্থে ‘জনসমাজ’ বলতে বােঝায় সেই জনসমষ্টিকে যাদের ভাষা, সাহিত্য, প্রথা, ধর্ম ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিভিন্নতা সত্ত্বেও কোনাে একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বহুকাল ধরে বসবাস করে একই রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে এবং তাদের মধ্যে দীর্ঘকালব্যাপী পারস্পরিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কার্যকলাপের আদানপ্রদান লক্ষ করা যায়।


প্রশ্ন ১৫। জাতি ও রাষ্ট্রের মধ্যে পার্থক্য কী?

উত্তর: (ক) রাষ্ট্রের প্রধান উপাদান চারটি—জনসমষ্টি, নির্দিষ্ট ভূখণ্ড, সরকার ও সার্বভৌমত্ব। কিন্তু জাতিগঠনের মূল উপাদান জাতীয় জনসমাজের মধ্যে গভীর ঐক্যবােধ ও রাজনৈতিক চেতনা।

(খ) রাষ্ট্রের সীমানা জাতির সীমানার চেয়ে ছােটো। এবং

(গ) রাষ্ট্র একটি আইনগত ধারণা। কিন্তু জাতির ধারণা ভাবগত।


প্রশ্ন ১৬। জাতীয় জনসমাজের প্রধান উপাদানগুলি কী কী?

উত্তর: জাতীয় জনসমাজের প্রধান উপাদানগুলি হল— ভৌগােলিক সান্নিধ্য, বংশগত ঐক্য, ভাষাগত ঐক্য, ধর্মগত ঐক্য, রাজনৈতিক ঐক্য, অর্থনৈতিক সমস্বার্থ ও ভাবগত উপাদান।


প্রশ্ন ১৭। জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের অর্থ কী?

উত্তর: প্রত্যেক জাতির পৃথক রাষ্ট্রগঠনের দাবি বা জাতীয় জনসমাজে নিজের রাজনৈতিক ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের দাবিকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বলে। অর্থাৎ জাতীয়তার ভিত্তিকে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের অধিকারকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বলে। এই তত্ত্ব অনুসারে এক একটি জাতি নিয়ে এক একটি রাষ্ট্র গঠিত হবে।


প্রশ্ন ১৮। জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের বিরােধী দুজন প্রবক্তার নাম লেখাে।

উত্তর: লর্ড অ্যাক্টন, লর্ড কার্জন জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের বিরােধী।


প্রশ্ন ১৯। জাতীয়তাবাদী ধারণার কয়েকজন মুখ্য প্রবক্তার নাম লেখাে।

উত্তর: চার্লস লয়েড, রাসেল, ল্যাস্কি, ম্যাৎসিনি, জিমান প্রমুখরা জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রবক্তা।


প্রশ্ন ২০। জাতীয়তাবাদের সীমাবদ্ধতা কী?

উত্তর: (ক) উগ্র জাতীয়তাবােধ জাত্যাভিমান সৃষ্টি করে সভ্যতার সংকট ডেকে আনে।

(খ) ল্যাস্কির মতে, ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে জাতীয়তাবাদ সাম্রাজ্যবাদে রূপান্তরিত হয়। এবং

(গ) উগ্র জাতীয়তাবাদ বিশ্বশান্তির বিরােধী ও অন্যায়ের উৎস।


প্রশ্ন ২১। “বিকৃত জাতীয়তাবাদ” বলতে তুমি কী বােঝ?

উত্তর: জাতীয়তাবাদ যখন আদর্শভ্রষ্ট হয়ে সংকীর্ণ স্বাদেশিকতা ও উগ্র জাত্যভিমানে পরিণত হয় তখন তাকে বিকৃত জাতীয়তাবাদ বলা হয়।


প্রশ্ন ২২। আন্তর্জাতিকতাবাদের কয়েকজন প্রবক্তার নাম লেখাে।

উত্তর: বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, দান্তে, মার্কস, লেনিন প্রমুখ মনীষীরা আন্তর্জাতিকতাবাদের সমর্থক।


প্রশ্ন ২৩। আন্তর্জাতিকতাবাদের উপযােগিতা কী?

উত্তর: (ক) উগ্র জাতীয়তাবাদের হাত থেকে বিশ্বসভ্যতা রক্ষা করে।

(খ) পৃথিবীর সভ্য জাতিসমূহের সমৃদ্ধি ও উন্নতি এবং তাদের মধ্যে পারস্পরিক সহযােগিতা বৃদ্ধি করে। এবং

(গ) বিশ্বশান্তি ও সৌভ্রাতৃত্ব রক্ষার জন্য আন্তর্জাতিকতাবাদের প্রয়ােজন। 


প্রশ্ন ২৪। আন্তর্জাতিকতাবাদের আসল বক্তব্য কী?

উত্তর: আন্তর্জাতিকতাবাদের আসল বক্তব্য হল “নিজে বাঁচ এবং অপরকে বাঁচাও’ (Live and Let Live)।


প্রশ্ন ২৫। কার্জন আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে দু-দিকে ধার আছে এমন একটি অস্ত্র বলে বর্ণনা করেছেন কেন?

উত্তর: লর্ড কার্জন আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে দু-দিকে ধার আছে এমন একটি অস্ত্র বলে বর্ণনা করেছেন। কারণ, এই নীতিটি যেমন একদিকে রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন একটি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা জোগায়, অন্যদিকে তেমনি ভিন্ন ভিন্ন জাতিকে বিচ্ছিন্ন করে তাদের সংহতি বিনষ্ট করে এবং তাদের মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণা, সন্দেহ, বিদ্বেষ প্রভৃতির জন্ম দেয়। ফলে যুদ্ধের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়।


প্রশ্ন ২৬। আদর্শ জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি কী?

উত্তর: জাতীয়তাবাদের মহান আদর্শ গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণার অনুপন্থী হিসাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষকে মুক্তি সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছে। এই আদর্শ জাতিকে আত্মপ্রত্যয়ের যেমন শিক্ষা দেয়, তেমনি সমস্ত ক্ষুদ্রতা ও সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রেরণা জোগায়। বস্তুত, আদর্শ জাতীয়তাবাদ ‘নিজে বাঁচ, অপরকে বাঁচতে দাও’—এই সুমহান আদর্শ প্রচার করে বিশ্বসভ্যতার প্রগতির পথ উন্মুক্ত করেছে।


অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর


Q. ‘জাতীয় জনসমাজের সীমারেখা রাষ্ট্রের সীমারেখার সঙ্গে সমানুপাতিক হওয়া উচিত’ -উক্তিটি কার?

উত্তর: ‘জাতীয় জনসমাজের সীমারেখা রাষ্ট্রের সীমারেখার সঙ্গে সমানুপাতিক হওয়া উচিত’- বলেছেনজে. এস. মিল।

Q. ‘জাতীয়তাবাদ সভ্যতার সংকটস্বরূপ’- কে একথা বলেছেন?

উত্তর: ‘জাতীয়তাবাদ সভ্যতার সংকটস্বরূপ’- একথা বলেছেনরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

Q. ভারতীয়গণ কী একটি জাতি?

উত্তর: ভারতীয়গণ একটি জাতি।

Q. জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নীতিটিকে দু-দিক ধারবিশিষ্ট তলোয়ার বলেছেন কে?

উত্তর: জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নীতিটিকে দু-দিক ধারবিশিষ্ট তলোয়ার- বলেছেনলর্ড কার্জন।

Q. ‘জাতি হল ঐতিহাসিক ভাবে গড়ে ওঠা একটি স্থায়ী জনসমষ্টি যা একই ভাষা, অঞ্চল, অর্থনৈতিক জীবন এবং সংস্কৃতির মধ্যে অভিব্যক্তি মনস্তাত্ত্বিক গঠনের ভিত্তিতে গঠিত’।- একথা বলেছেন কে?

উত্তর: ‘জাতি হল ঐতিহাসিক ভাবে গড়ে ওঠা একটি স্থায়ী জনসমষ্টি যা একই ভাষা, অঞ্চল, অর্থনৈতিক জীবন এবং সংস্কৃতির মধ্যে অভিব্যক্তি মনস্তাত্ত্বিক গঠনের ভিত্তিতে গঠিত’ -একথা বলেছেনস্তালিন।

Q. কে জাতীয়তাবাদকে আন্তর্জাতিকতার বিরোধী মনে করেন?

উত্তর: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরজাতীয়তাবাদকে আন্তর্জাতিকতার বিরোধী মনে করেন।

Q. ইতালির জাতীয়তাবাদের জনক কে?

উত্তর: ইতালির জাতীয়তাবাদের জনক হলেনম্যাৎসিনি।

Q. ল‍্যাস্কির মতে, কখন থেকে আধুনিক জাতীয়তাবাদের সূচনা হয়?

উত্তর: লাস্কির মতে পোল্যান্ডের বিভক্তিকরণের সময় থেকে আধুনিক জাতীয়তাবাদের সূচনা হয়।

Q. উগ্র জাতীয়তাবাদ কে ‘সভ্যতার শত্রু’ বলেছেন কে?

উত্তর: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উগ্র জাতীয়তাবাদ কে ‘সভ্যতার শত্রু’ বলেছেন।

Q. জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতার পথকে উন্মুক্ত করে, কে বলেছেন?

উত্তর: জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতার পথকে উন্মুক্ত করে,  একথা বলেছেনজিমান‍‍‍‍‍।

Q. ‘জাতীয়তাবাদ হল আধুনিক বিশ্বের একটি ধর্ম’- একথা কে বলেছেন?

উত্তর: ‘জাতীয়তাবাদ হল আধুনিক বিশ্বের একটি ধর্ম’- একথা বলেছেনলয়েড।

Q. জাতি কাকে বলে?

উত্তর: রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত, বহি‍ঃশাসন থেকে সর্বপ্রকারে মুক্ত অথবা মুক্তিকামী একটি নির্দিষ্ট জনসমাজকে জাতি বলা হয়।

Q. ‘জাতীয়তাবাদের রাজপথ ধরেই আন্তর্জাতিকতায় পৌঁছানো যায়’- কে বলেছেন?

উত্তর: ‘জাতীয়তাবাদের রাজপথ ধরেই আন্তর্জাতিকতায় পৌঁছানো যায়’- একথা বলেছেনজিমান‍‍‍ (Zimmern)।

Q. জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের বিরোধী একজন ইংরেজ দার্শনিক এর নাম উল্লেখ করো।

উত্তর: জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের বিরোধী একজন ইংরেজ দার্শনিক এর নাম হললর্ড অ্যাক্টন।

Q. কে বলেছেন- ‘জাতীয়তাবাদ হল সহগামিতার যৌথ সচেতনতা’?

উত্তর: শোয়ারজেনবার্জারবলেছেন- ‘জাতীয়তাবাদ হল সহগামিতার যৌথ সচেতনতা।

Q. কে বলেছেন,- ‘জাতীয় জনসমাজ মূলত একটি আত্মিক প্রশ্ন’?

উত্তর: জিমানবলেছেন,- ‘জাতীয় জনসমাজ মূলত একটি  আত্মিক প্রশ্ন’।

Q. ‘কুলগত ঐক্যের ভিত্তিতে জাতীয় জনসমাজকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা সম্পূর্ণ অর্থহীন’ কে বলেছেন?

উত্তর: শেফারবলেছেন- ‘কুলগত ঐক্যের ভিত্তিতে জাতীয় জনসমাজকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা সম্পূর্ণ অর্থহীন’।

Q. কে জাতীয়তাবাদকে মানুষের পাগলামি বলে অভিহিত করেছেন?

উত্তর: এরিক ফ্রোমজাতীয়তাবাদকে মানুষের পাগলামি বলে অভিহিত করেছেন।

Q. ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’- উক্তিটি কার?

উত্তর: ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’  উক্তিটিকাল মার্কস-এর।

Q. জাতীয় জনসমাজ কি?

উত্তর: জাতীয় জনসমাজ হল এমন একটি ঐক্যবদ্ধ জনসমাজ যে নিজেকে অন্য  জনসমাজ থেকে সম্পূর্ণ পৃথক বলে মনে করে।

Q. জাতীয়তাবাদ কে একটি ‘সাদৃশ্য ও ঐক্যের অনুভূতি’ বলে চিহ্নিত করেছেন কে?

উত্তর: জাতীয়তাবাদকে একটি ‘সাদৃশ্য ও ঐক্যের অনুভূতি’ বলে চিহ্নিত করেছেনবার্ট্রান্ড রাসেল।

Q. জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের একজন প্রবক্তার নাম উল্লেখ করো।

উত্তর: জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের একজন প্রবক্তার নাম হলউড্রো উইলসন।

Q. কি ধরনের জাতীয়তাবাদ সাম্রাজ্যবাদের জন্ম দেয়?

উত্তর: উগ্র জাতীয়তাবাদ সাম্রাজ্যবাদের জন্ম দেয়।

Q. জাতীয়তাবাদের জনক কাকে বলা হয়?

উত্তর: ম্যাৎসিনিকেজাতীয়তাবাদের জনক বলা হয়।

Q. ‘জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার’- মতবাদটির প্রবক্তা কে?

উত্তর: ‘জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার’- মতবাদটির প্রবক্তা হলেনজন স্টুয়ার্ট মিল।

Q. বিকৃত জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা কে?

উত্তর: বিকৃত জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা হলেনহিটলার।

Q. ‘কোনো জনসমাজকে তাদের নিজস্ব জাতীয় সরকার ব্যতিরেকে অন্য জাতির এর অধীনে থাকতে বাধ্য করা, কোন নারীকে, সে ঘৃণা করে এমন পুরুষকে বিবাহ করতে বাধ্য করার সমতুল্য’ -কার উক্তি?

উত্তর: ‘কোনো জনসমাজকে তাদের নিজস্ব জাতীয় সরকার ব্যতিরেকে অন্য জাতির এর অধীনে থাকতে বাধ্য করা, কোন নারীকে, সে ঘৃণা করে এমন পুরুষকে বিবাহ করতে বাধ্য করার সমতুল্য’-  এই  উক্তিটি করেছেনরাসেল।

Q. ‘আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ইতিহাসের পশ্চাৎগতির লক্ষণ’-  কে বলেছেন?

উত্তর: ‘আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ইতিহাসের পশ্চাৎগতির লক্ষণ’-  একথা বলেছেনলর্ড অ্যাক্টন।

Q. ‘যথার্থ দেশপ্রেম জাতীয়তাবাদের আদর্শের মাধ্যমে মূর্ত হলে বিশ্বসভ্যতা এবং মানবতার পক্ষে তা আশীর্বাদস্বরূপ’- উক্তিটি কার?

উত্তর: ‘যথার্থ দেশপ্রেম জাতীয়তাবাদের আদর্শের মাধ্যমে মূর্ত হলে বিশ্বসভ্যতা এবং মানবতার পক্ষে তা আশীর্বাদস্বরূপ’-অধ্যাপক হায়েস-এর উক্তি।

Q. ‘জাতীয়তাবাদ যদি নিয়ন্ত্রিত হয় তাহলে আর বিকৃত বা সংকীর্ণ হতে পারে না’- কে বলেছেন?

উত্তর: অধ্যাপক বাকা‍রবলেছেন- ‘জাতীয়তাবাদ যদি নিয়ন্ত্রিত হয় তাহলে আর বিকৃত বা সংকীর্ণ হতে পারে না।’

Q. ‘হয় মানুষ যুদ্ধকে শেষ করবে, না হয় যুদ্ধইমানুষকে শেষ করবে’ কে বলেছেন?

উত্তর: অধ্যাপক রাসেল বলেছেন,- ‘হয় মানুষ যুদ্ধকে শেষ করবে, না হয় যুদ্ধই মানুষকে শেষ করবে’।

Q. ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বিকল্প হল সম্মিলিত ধ্বংস’ কার উক্তি?

উত্তর: ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বিকল্প হল সম্মিলিত ধ্বংস’-  উক্তিটি হল জহরলাল নেহেরু-র।

Q. ‘স্ত্রীলোকের নিকট মাতৃত্ব যেমন স্বাভাবিক,  পুরুষের নিকট যুদ্ধও তেমনি স্বাভাবিক’-  উক্তিটি কার?

উত্তর: ‘স্ত্রীলোকের নিকট মাতৃত্ব যেমন স্বাভাবিক,  পুরুষের নিকট যুদ্ধও তেমনি স্বাভাবিক’-  উক্তিটি করেছেন মুসোলিনি।


বর্ণনামূলক প্রশ্নোত্তর


প্রশ্ন ১) জাতির সংজ্ঞা দাও। জাতির বৈশিষ্ট্যগুলি লেখাে।

উত্তর: মানবসমাজের বিবর্তনের ইতিহাসে জনসমাজ, জাতীয় জনসমাজ এবং জাতি নির্দিষ্ট রূপকে সূচিত করে। একটি জনসমাজের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটলে তাকে জাতীয় জনসমাজ বলে। রাজনৈতিক চেতনা সম্বন্ধে জনসমাজ যখন নিজ স্বাতন্ত্র্য রক্ষার জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র গড়ে তােলার জন্য সচেষ্ট হয় অথবা স্বাধীন রাষ্ট্রে বসবাস করে, তখন এই সংগঠিত জাতীয় জনসমাজকে জাতি বলে। অধ্যাপক গিলকাইস্টের মতে একটি রাষ্টের অধীনে সুগঠিত জনসমাজকে জাতি বলা হয়।

উদাহরণস্বরুপ ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের আগে ভারত একটি জাতীয় জনসমাজ ছিল। পরবর্তীকালে ভারতীয়দের মধ্যে সক্রিয় রাজনৈতিক চেতনা আবির্ভাবের ফলে ভারতীয়গণ সংগঠিত জাতিতে রপান্তরিত হয়। সুতরাং জাতীয় জনসমাজের সঙ্গে রাজনৈতিক সংগঠন যুক্ত হলেই জাতি সৃষ্টি হল।

এর বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করা হল—(i) একটি সরকার সম্পর্কে ধারণা। (ii) সব জনগােষ্ঠীর মধ্যে গভীর সম্পর্ক। (iii) মােটামুটিভাবে একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ড। (iv) ভাষা, বর্ণ, ধর্ম ও জাতীয় চরিত্রগত ঐক্যবােধ। (v) বিভিন্ন জনগােষ্ঠীর স্বার্থরক্ষা করা এবং জনগণের মধ্যে জাতীয় মনােভাবের উপস্থিতি।


প্রশ্ন ২) “এক জাতি এক রাষ্ট্র”– এই তত্ত্বটির সমালােচনা উল্লেখ করাে।

উত্তর: লর্ড অ্যাক্টন, লর্ড কার্জন প্রভৃতি চিন্তাবিদরা আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নীতির বিভিন্ন দিক দিয়ে সমালােচনা করেছেন। কারণ-

প্রথমত,  এই অধিকার স্বীকৃত হলে বড়াে বড়াে রাষ্ট্র ভেঙে অনেক ছােটো ছােটো রাষ্ট্র তৈরি হবে। ছােটো দেশ সুইজারল্যান্ড তিনটি রাষ্ট্রে পরিণত হবে। ইউরােপের আঠাশটি দেশ ভেঙে আটষট্টিটি হবে। এতে সীমানা নিয়ে আরও বেশি বিরােধ দেখা যাবে। বিশ্বশান্তি বিঘ্নিত হবে। এছাড়া, বড়াে রাষ্ট্রের নাগরিকরা যা মর্যাদা পায়, ছােটো রাষ্ট্রের নাগরিকরা তা পাবে না।

দ্বিতীয়ত, “এক জাতি, এক রাষ্ট” নীতি কার্যকর হলে, অনেক ছােটো রাষ্ট্র গড়ে উঠবে। তারা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্বনির্ভর হতে পারবে না। ফলে শক্তিশালী রাষ্ট্রের তাঁবেদার হিসাবে তাদের থাকতে হবে। সেক্ষেত্রে তাদের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হবে।

তৃতীয়ত, এই নীতিকে বাস্তবে রূপ দেওয়া খুব শক্ত। কারণ, একই ভৌগােলিক পরিবেশে বিভিন্ন জাতি দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করায়, তারা এমনভাবে মিশে গেছে যে তাদের পৃথক করা প্রায় অসম্ভব।

চতুর্থত, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সব সময় কোনাে জাতির পক্ষে আশীর্বাদ নাও হতে পারে। লর্ড অ্যাক্টন বলেছেন “অনুন্নত জাতি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবি না জানিয়ে, যদি উন্নত জাতির সঙ্গে বসবাস করে, তাহলে উন্নত জাতির সংস্পর্শে এসে তারা বরং উন্নত হতে পারবে।”

পঞ্চমত, “এক জাতি, এক রাষ্ট্র” নীতি একটা জাতির পক্ষে আশীর্বাদ নাও হতে পারে। বিশেষ করে ছােটো ছােটো রাষ্ট্রগুলি অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত হতে পারে। যেমন, ভারত ও পাকিস্তান ভাগ হলে পশ্চিমবঙ্গের পাটশিল্পের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।

ষষ্ঠত, এই দাবি স্বীকৃত হলে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি জন্ম নেবে। তাতে জাতীয় সংহতি বিনষ্ট হবে।

সপ্তমত, এই নীতি একবার স্বীকৃত হলে বড়াে রাষ্ট্র ভাঙতে ভাঙতে তা শেষ পর্যন্ত এমন পর্যায়ে পৌঁছােবে যে তার পরিণতি ভয়ংকর হতে পারে। শেষ পর্যন্ত হয়তাে দেখা যাবে, সেই ভাঙনের ঢেউ গ্রামের সীমানায় এসে পৌঁছে গেছে।

অষ্টমত, বলা হয় একাধিক জাতি নিয়ে গঠিত রাষ্ট্র দুর্বল হবে, ঐক্য থাকবে না। কিন্তু একথা সত্য নয়। সুইজারল্যান্ড বহু জাতিভিত্তিক দেশ। তথাপি সে ঐক্যবদ্ধ। অনেক জাতি নিয়ে গঠিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী।

নবমত, উইলসন বলেছেন, এই নীতি স্বীকৃত হলে সংখ্যালঘুদের সমস্যা মিটবে। শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের ভিত্তিতে পাকিস্তান গঠিত হলেও ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বরং উপমহাদেশে অশান্তি আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।


প্রশ্ন ৩) জাতীয় জনসমাজ বলতে কী বােঝ? এর বৈশিষ্ট্যগুলি লেখাে।

উত্তর: জাতীয় জনসমাজ হল জনসমাজের এক উন্নত স্তর বিশেষ। জনসমাজের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত হলে জাতীয় জনসমাজের উদ্ভব হয়। ইংরেজি Nationality শব্দটির দ্বারা জাতীয় ঐক্যের চেতনা বা জাতীয় ভাবকেও বােঝানাে হয়। জনসমাজের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত হলে তারা নিজেদের সরকার গঠন করতে চায় এবং জাতীয় জনসমাজে রূপান্তরিত হয়।

যেসব কারণে একটি জনসমষ্টি জাতীয় জনসমাজে উন্নীত হয়, সেই ঐক্যের উপাদানগুলিকে জাতীয় জনসমাজের উপাদান বলে। এই উপাদানগুলিকে দুভাগে ভাগ করা যায়। (ক) বাহ্যিক উপাদান এবং (খ) ভাবগত উপাদান।

জাতীয় জনসমাজের বৈশিষ্ট্যগুলি নিম্নে উল্লেখ করা হল-(i) ঐক্যবদ্ধ সমাজচেতনা সম্পন্ন জনসমাজ। (ii) লর্ড ব্রাইসের মতে, নিজেদের মধ্যে ঐক্য এবং অপরাপর জনগােষ্ঠী থেকে পার্থক্যবােধ জাতীয় জনসমাজের বৈশিষ্ট্য। (iii) এখানে আছে সামাজিক ঐক্যবােধ, রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন মানুষ। (iv) উন্নত মানসিকতা —এই মানসিকতার পরিচয় না দিলে তাদের জাতীয় জনসমাজ বলে গণ্য করা যায় না।


প্রশ্ন ৪) জাতীয়তাবাদ কাকে বলে? জাতীয়তাবাদের কী কী বৈশিষ্ট্য আছে?

উত্তর: জাতীয়তাবাদ হল স্বজাতির প্রতি ভালােবাসা। দেশের মানুষকে আপন করে নেবার মানসিকতা। এটি একটি মহৎ রাজনৈতিক আদর্শ। পরাধীন জাতিকে শৃঙ্খলিমােচনের সংগ্রামে এই আদর্শ প্রেরণা দিয়েছে। জাতীয় ঐক্যসাধনের ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদের কোনাে বিকল্প নেই।

যখন কোনাে জনসমষ্টি বংশ, ভাষা, ধর্ম প্রভৃতি কারণে ঐক্যবদ্ধ হয় তখন তাদের বলা হয় জনসমাজ। যখন এই জনসমাজের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা জাগে, তখন তাদের বলা হয় জাতীয় জনসমাজ। জাতীয় জনসমাজের মানুষেরা প্রত্যেকে অপরের সুখ-দুঃখে সমান অংশীদার বলে মনে করে। অন্য জনসমাজ থেকে নিজেদের পৃথক বলে ভাবতে শেখে। প্রত্যেকে নিজেদের ভাষা, ধর্ম,

সাহিত্য ইত্যাদির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়। এগুলিকে সংরক্ষণ করার জন্য তাদের মধ্যে পৃথক রাষ্ট্র গঠনের ইচ্ছা জাগে। এই চেতনা তাদের ঐক্যবােধকে গভীরতর করে। জাতির প্রতি এই ভালােবাসা ও একাত্ববােধের নাম হলজাতীয়তাবাদ। তাই রাসেল (Russell) বলেছেন, “জাতীয়তাবাদ হল ঐক্যের অনুভূতি।”

জাতীয়তাবাদের বৈশিষ্টগুলি আলােচনা করা হল-(i) নিজেদের মধ্যে গভীর ঐক্যবােধ গড়ে তােলে। (ii) অন্যান্য জনসমাজ থেকে স্বাতন্ত্র্যবােধের জন্ম দেয়। (iii) ভিন্ন ভিন্ন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ভিন্ন ভিন্ন প্রকৃতির জাতীয়তাবাদ, যেমন— উপ-জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি করে। (iv) অধ্যাপক ল্যাস্কির মতে, জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হল মানুষের সত্তা পাবার ইচ্ছা যা থেকে স্বাতন্ত্রশাসন প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা গড়ে ওঠে।


প্রশ্ন ৫) “প্রকৃত জাতীয়তাবাদ সভ্যতার শত্রু নয়” ব্যাখ্যা করাে।

উত্তর: জাতীয়তাবাদ হল জাতির প্রতি ভালােবাসা। দেশের মানুষকে আপন করে নেবার মানসিকতা। এটি একটি মহৎ রাজনৈতিক আদর্শ। পরাধীন জাতিকে শৃঙ্খলমােচনের সংগ্রামে এই আদর্শ প্রেরণা দিয়েছে। জাতীয় ঐক্য সাধনের ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদের কোনাে বিকল্প নেই। প্রকৃত জাতীয়তাবাদ সভ্যতার শত্রু নয়। কারণ-

প্রথমত, প্রকৃত জাতীয়তাবাদের নীতি হল,—নিজে বাঁচ ও অপরকে বাঁচতে দাও। এর উদ্দেশ্য হল, —বিভিন্ন জাতির মধ্যে সহযােগিতার সম্পর্ক গড়ে তােলা। একমাত্র এরই মাধ্যমে বিশ্বসভ্যতা সমৃদ্ধ হতে পারে। তাই এটি আন্তর্জাতিকতার বিরােধী নয়।।

দ্বিতীয়ত, প্রকৃত জাতীয়তাবাদে অনুপ্রাণিত হলে জাতি নিজস্ব রাষ্ট্র গঠন করে নিজেদের বৈশিষ্ট্যকে বিকাশ করতে পারবে। এইভাবে প্রত্যেক জাতি বিকশিত হলে বিশ্বের সভ্যতার সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে। ম্যাৎসিনি যথার্থই বলেছেন, “প্রত্যেক জাতির কতকগুলি গুণ থাকে এবং সেগুলি একত্রে মানবজাতির অমূল্য সম্পদ।”

তৃতীয়ত, সাম্রাজ্যবাদ অপর জাতিকে শােষণ করে। বিশ্বের সভ্যতাকে ধ্বংস করে। বিভিন্ন দেশের মানুষেরা জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে অনুপ্রাণিত হলে আন্দোলনের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হবে। তাতে বিশ্বের সভ্যতা বাঁচবে।

চতুর্থত, প্রকৃত জাতীয়তাবাদ দেশের প্রতি ভালােবাসা জাগায়। দেশের প্রতি এই ভালােবাসা দেশের ঐক্য ও সংহতি গড়ে তােলে। তাতে দেশের সমৃদ্ধির পথ প্রশস্ত হয়।


প্রশ্ন ৬) জাতীয়তাবাদের কী কী ত্রুটি বা সীমাবদ্ধতা আছে?

উত্তর: বিভিন্ন মনীষী ও রাজনীতিবিদ জাতীয়তাবাদের সমালােচনা করেছেন। তাদের যুক্তি হল—

(i) মানবসভ্যতা বিপন্ন করে : জাতীয়তাবাদ যদি অন্ধ আবেগের উপর নির্ভরশীল হয় তবে তার পরিণতি ভয়াবহ হয়। এর ফলে একটি জাতি নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে এবং অন্যকে অবজ্ঞা করে। জন্ম দেয় বিকৃত জাতীয়তাবাদের। মানবসভ্যতা বিপন্ন হয়।

(ii) অগ্রগতি ব্যাহত হয় : উগ্র জাতীয়তাবাদ জাতিকে কুপমণ্ডুক ও রক্ষণশীল করে তােলে। নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, অন্যেরও ক্ষতি করে। দেশের অগ্রগতি ব্যাহত হয়।

(iii) বিশ্বশান্তি বিঘ্নিত হয় : বিকৃত জাতীয়তাবাদ যুদ্ধ ডেকে আনে। এর ফলে বিশ্বশান্তি বিঘ্নিত হয়। স্বৈরতন্ত্র মাথা চাড়া দেয়। সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র উৎসাহিত হয়। সাম্রাজ্যবাদের নিষ্ঠুর আক্রমণে লক্ষ লক্ষ মানুষ অত্যাচারিত হয়।

(iv) অগণতান্ত্রিক : জাতীয়তাবাদের হিংস্র চেহারা গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণার বিরােধী। উগ্র জাতীয়তাবাদ সমস্ত অন্যায় ও অমঙ্গলের উৎস। তবে প্রকৃত দেশপ্রেম জাতীয়তাবাদের আদর্শের মধ্যে মূর্ত হলে অধ্যাপক হায়েসের (Hayes) ভাষায় তা হবে ‘বিশ্ব সভ্যতা এবং মানব সভ্যতার কাছে আশীর্বাদস্বরূপ।


প্রশ্ন ৭) আন্তর্জাতিকতাবাদের সংজ্ঞা দাও। আন্তর্জাতিকতাবাদের বৈশিষ্ট্যগুলি কী কী?

উত্তর: আন্তর্জাতিকতার সংজ্ঞা সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা একমত হতে পারেননি। কেউ কেউ বলেছেন,—আন্তর্জাতিকতা বলতে বােঝায় জাতীয় রাষ্ট্রের পরিবর্তে বিশ্বরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। এই সংজ্ঞা গ্রহণযােগ্য নয়। কারণ, অনেকে মনে করেন, প্রত্যেক জাতির মধ্যে বিশেষ গুণ আছে। সেই গুণগুলি বিকশিত হলে বিশ্বের সভ্যতা সমৃদ্ধ হবে। তাই জিমান বলেছেন, —“জাতীয়তাবাদেরপথ ধরে আন্তর্জাতিকতায় পৌঁছানাে যায়।”

তাই বিশ্বসভ্যতার প্রয়ােজনে প্রকৃত জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিশ্বের মানুষকে ভালােবাসতে হবে। এই ভালােবাসার নাম হল আন্তর্জাতিকতা। এটি একটি মানসিক অনুভূতি। এই অনুভূতির ফলে মানুষ নিজেকে বিশ্বের একজন নাগরিক হিসাবে মনে করে। তাদের সুখ-দুঃখে সমান অংশীদার হিসাবে ভাবতে শেখে। “নিজে বাঁচ এবং অপরকে বাঁচতে দাও”—এই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়।

এই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে প্রত্যেকের মধ্যে অপর জাতির মানুষকে আপন করে নেবার মানসিকতা জাগে। বিশ্বকবির ভাষায় -“দূরকে করিলে নিকট বন্ধু, পরকে করিলে ভাই”। এইভাবে বিশ্বের সবাইকে আপন করে নেবার চিন্তা-ভাবনার নাম হল আন্তর্জাতিকতা।


 নিম্নে আন্তর্জাতিকতাবাদের বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করা হল—

(i) আন্তর্জাতিকতার আদর্শ মানবজাতির মধ্যে প্রীতি ও ভালােবাসার সম্পর্ক গড়ে তােলে।

(ii) আন্তর্জাতিকতার লক্ষ্য হল সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা। এর আদর্শ প্রত্যেক জাতিকে আত্মত্যাগ করতে শেখায়।

(iii) আন্তর্জাতিকতাবাদ জাতীয়তাবাদকে নিয়ন্ত্রণ করে। আর জাতীয়তাবাদ যদি নিয়ন্ত্রিত হয় তাহলে জাতীয়তাবাদ বিকৃত হতে পারে না।

(iv) মার্কসবাদী মতে শ্রমিকশ্রেণির আন্তর্জাতিকতার পথে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের ইচ্ছাকে দূর করা যায়। দেশপ্রেমের সঙ্গে দুনিয়ার শ্রমিকশ্রেণির গভীর সম্পর্ক আছে।

(v) ‘নিজে বাঁচ এবং অপরকে বাঁচাও’ -হল আন্তর্জাতিকতার প্রধান বৈশিষ্ট্য।


প্রশ্ন ৮) আন্তর্জাতিকতাবাদের গুরুত্ব কী?

উত্তর: আন্তর্জাতিকতাবাদের অর্থ হল,—বিশ্বের প্রতি ভালােবাসা। এটি একটি মানসিক অনুভূতি। এই অনুভূতির ফলে মানুষ নিজেকে বিশ্বের একজন নাগরিক হিসাবে মনে করে। তার চিন্তাভাবনা নিজের রাষ্ট্রের সীমানা অতিক্রম করে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বের মানুষের কল্যাণে আত্মনিয়ােগ করতে উদ্বুদ্ধ হয়। পৃথিবীর প্রত্যেক জাতির মানুষকে আপন করে নেবার মানসিকতা জাগে। বিশ্বকবির ভাষায়, “দূরকে করিলে নিকট বন্ধু, পরকে করিলে ভাই”। আন্তর্জাতিকতাবাদের গুরুত্বগুলি হল নিম্নরূপ-

(i) বর্তমান যুগ আন্তর্জাতিকতাবাদের যুগ। পৃথিবীর রাষ্ট্রগুলি নানা কারণে আন্তর্জাতিকতাবাদের উপর দাঁড়িয়ে আছে।।

(ii) কোনাে জাতিই এককভাবে উন্নতি করতে পারে না। কোনাে রাষ্ট্রই আন্তর্জাতিকতাকে আহ্বান না করে বিশ্বে টিকে থাকতে পারে না।

(iii) আজকের দুনিয়ায় প্রতিটি রাষ্ট্রই ভয়াবহ মারণাস্ত্রে সজ্জিত। সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রজোট ইরাক ও আফগানিস্তানের উপর নগ্নভাবে আক্রমণ চালিয়েছে এবং বর্তমানে ইরানকে হুমকি দিচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদী এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকতাবাদ একটি মহান আদর্শ যা রাষ্ট্রগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করে।

(iv) আন্তর্জাতিকতাবােধ যত পরিণত হবে যুদ্ধের সম্ভাবনা ততই কমে যাবে। এর আদর্শকে রক্ষা করার জন্য জাতিপুঞ্জ নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। এইদিক থেকে বিচার করলে আন্তর্জাতিকতাবাদ আজ এক নতুন সাংগঠনিক মাত্রা লাভ করেছে। জওহরলাল নেহরু বলেছেন : “শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বিকল্প হল সম্মিলিত ধ্বংস”। আজকের দিনে এর গুরুত্ব সমস্ত বিরােধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে।


প্রশ্ন ৯) “এক জাতি, এক রাষ্ট্র”—এই তত্ত্বটির পক্ষে কী কী যুক্তি দেওয়া হয়?

উত্তর: উড্রো উইলসন, জে. এস. মিল প্রভৃতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে সমর্থন করে নিম্নলিখিত যুক্তিগুলি দিয়েছেন—

প্রথমত, প্রত্যেক জাতির নিজস্ব কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য আছে। ম্যাৎসিনি বলেছেন, —এগুলি হল মানবজাতির সম্পদ। তাই এগুলির সংরক্ষণ ও বিকাশের জন্য সেই জাতিকে পৃথক রাষ্ট্র গড়তে দেওয়া উচিত। বহুজাতি বা জনগােষ্ঠীকে নিয়ে রাষ্ট্র গঠিত হলে সংখ্যালঘু জাতির দাবি উপেক্ষিত হবে। ফলে তাদের বিকাশের পথে বাধা সৃষ্টি হবে।

দ্বিতীয়ত, এই অধিকার গণতান্ত্রিক। গণতন্ত্রের অর্থ হল জনগণের শাসন। কোনাে জাতি নিজস্ব রাষ্ট্র গঠন করার সুযােগ পেলে তারা নিজেদের শাসনব্যবস্থায় ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করার সুযােগ পাবে। বিভিন্ন জাতি নিয়ে রাষ্ট্র গঠিত হলে, সংখ্যালঘুরা এই সুযােগ পাবে না।

তৃতীয়ত, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী উড্রো উইলসন বলেছেন, —’”ই অধিকার স্বীকৃত হলে, পৃথিবী থেকে যুদ্ধ দূর হয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে।” কারণ, কোনাে জাতির স্বাধীনতার অধিকার উপেক্ষিত হলে যুদ্ধের মাধ্যমে তার অধিকার প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হবে। কিন্তু যুদ্ধ শান্তির পথকে কণ্টকিত করে। তাই তিনি সাবধান করে দিয়ে বলেছেন,—“আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার একটি কথার কথা নয়, এটি অবশ্য পালনীয় কর্তব্য।”

চতুর্থত, একটি ফুলের বাগানে বিভিন্ন ধরনের ফুল ফুটলে যেমন বাগানের শােভা বৃদ্ধি পায়, তেমনি প্রত্যেক জাতি আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার পেয়ে আপন বৈশিষ্ট্যে বিকশিত হলে, বিশ্বসভ্যতার সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে।

পঞ্চমত, বিভিন্ন জাতি একই রাষ্ট্রে বসবাস করলে তাদের মধ্যে অবিরাম জাতিগত সংঘর্ষ লেগে থাকবে। তাতে রাষ্ট্রের মধ্যে ঐক্য থাকবে না। রাষ্ট্রের ভিত দুর্বল হবে। একটি জাতি নিয়ে রাষ্ট্র গঠিত হলেরাষ্ট্র শক্তিশালী হবে।

ষষ্ঠত, প্রতিটি জাতির জন্যে পৃথক রাষ্ট্র গঠনের অধিকার একটি নীতিসম্মত অধিকার। বিভিন্ন জাতিকে জোর করে এক রাষ্ট্রে বসবাস করতে বাধ্য করা নীতিসম্মত নয়। বিখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রাসেল বলেছেন, কোনাে নারীকে তার ঘৃণা করা পুরুষকে বিয়ে করতে বাধ্য করলে যা অবস্থা হবে, কোনাে জনসমাজকে অন্য জনসমাজের অধীনে থাকতে বাধ্য করলে সেই অবস্থা হবে।”


প্রশ্ন ১০) ‘ভারত একটি জাতি, এর সমর্থনে যুক্তি দাও।

উত্তর: বর্তমানে ভাষা, ধর্ম, বংশ প্রভৃতি উপাদান জাতি গঠনে অপরিহার্য নয়। সুইজারল্যান্ডের মানুষ বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। তবুও তারা এক জাতি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ বিভিন্ন বংশ থেকে এসেছে। তবুও তারা ঐক্যবদ্ধ একটি জাতি।

প্রকৃতপক্ষে, জাতীয়তাবােধ একটা ভাবগত ধারণা। যদি কোনাে জনসমষ্টি মনে করে তাদের মধ্যে ভাষাগত, ধর্মগত ও বংশগত প্রভৃতি ক্ষেত্রে যতই পার্থক্য থাকুক না কেন, তারা ঐক্যবদ্ধ, তাহলে তারা এক জাতিতে পরিণত হতে পারে।

ভারতের ক্ষেত্রে একথা প্রযােজ্য। এখানে ভাষাগত, ধর্মগত, বংশগত প্রভৃতি ক্ষেত্রে পার্থক্য আছে সত্য। তা সত্ত্বেও ভারতবাসী ভাবগত কারণে ঐক্যবদ্ধ। তাই শক, হুন, পাঠান, মােগল ভারতের দেহে লীন হয়ে ভারতীয় হিসাবে পরিচিত হয়েছে। পাঞ্জাব, গুজরাট, মারাঠা, উল্কল ও বঙ্গের বাসিন্দারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। স্বাধীনতার পরে বিদেশিরা ভারত আক্রমণ করেছে। ভারতবাসী ঐক্যবদ্ধভাবে তার মােকাবিলা করেছে। দেশপ্রেম ও ঐক্যবদ্ধতা কার্গিল যুদ্ধে প্রমাণিত হয়েছে। এই দেশপ্রেম ও ঐক্যচেতনা ভারতের জাতীয়তাবাদকে শক্তিশালী করেছে।

একথা সত্য, ভারতের জাতীয় সংহতি আজ বিপন্ন। সাম্প্রদায়িকতা ও বিচ্ছিন্নতাবাদের অশুভ শক্তি আত্মপ্রকাশ করেছে। তবে মুষ্টিমেয় স্বার্থান্বেষী গােষ্ঠী বিদেশি মদত পেয়ে এ কাজ করছে। ভারতের জাতীয়তাবাদী মানুষ এই শক্তির বিরুদ্ধে সােচ্চার হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় ভারত এক জাতি।


প্রশ্ন ১১) জাতীয়তাবাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিকতাবাদের সম্পর্ক লেখাে।

উত্তর: জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদ হল বর্তমান বিশ্বের রাজনৈতিক চিন্তাজগতের দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের মধ্যে সম্পর্ক নির্ণয় নিয়ে রাষ্টবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। একদল চিন্তাবিদ মনে করেন আন্তর্জাতিকতার অর্থ হল বিশ্বরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা তথা জাতীয় রাষ্ট্রের অবলুপ্তি। আবার কোনাে কোনাে চিন্তাবিদ মনে করেন জাতীয়তার পথ ধরেই আন্তর্জাতিকতায় পৌঁছানাে যায়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “জাতীয়তাবাদ মানবতার শত্রু”। প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথ বিকৃত জাতীয়তাবাদের কথাই বলেছেন; পুঁজিবাদের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয়তাবাদ বিকৃত জাতীয়তাবাদে রুপান্তরিত হয়। বিকৃত জাতীয়তাবাদী ধারণার উন্মাদনায় বৃহৎ পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলি দুর্বল রাষ্ট্রগুলিতে প্রথমে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আধিপত্য কায়েম করে এবং তারপর সময়মতাে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সামগ্রিক প্রভুত্বের অধিকারী হয়। উগ্র তথা বিকৃত জাতীয়তাবাদই আন্তর্জাতিকতার শত্রু।

কিন্তু আদর্শ জাতীয়তাবাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিকতাবাদের কোনাে বিরােধ নেই। প্রকৃত জাতীয়তাবাদ হল একটি মহান আদর্শ। এই আদর্শ মানুষের মনে দেশপ্রেম সৃষ্টি করে। দেশপ্রেম মানুষকে যেমন দেশের জন্য আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ করে, তেমনি দেশ ও জাতির ঊর্ধ্বে উঠে বিশ্ববাসীকে ভালােবাসতেও শিক্ষা দেয়। যে স্বদেশ ও স্বজনকে ভালােবাসে সে বিশ্ববাসীকেও ভালােবাসে। প্রকৃত জাতীয়তাবােধই হল আন্তর্জাতিকতাবােধে উত্তরণের অন্যতম সােপান। জিমার্ন এর ভাষায়, “জাতীয়তাবাদের পথেই আন্তর্জাতিকতায় পৌঁছানাে সম্ভব।” প্রকৃত জাতীয়তাবাদ এবং আন্তর্জাতিকতার মূল কথাই হল- “নিজে বাঁচ এবং অন্যকে বাঁচতে দাও”। আদর্শ জাতীয়তাবাদ একটি প্রগতিশীল শক্তি। এটি আন্তর্জাতিকতার সহায়ক।


প্রশ্ন ১২) বিকৃত জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতার বিরােধী এবং সভ্যতার শত্রু -ব্যাখ্যা করাে।

উত্তর: বিকৃত বা উগ্র জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতার বিরােধী। এই বিকৃতি দুই ধরনের রাজনৈতিক বিকৃতি ও অর্থনৈতিক বিকৃতি।

রাজনৈতিক বিকৃতি

রাজনৈতিক বিকৃতির ফলে কোনাে জাতি নিজের বংশ, সাহিত্য, ধর্ম, ভাষা প্রভৃতিকে শ্রেষ্ঠ মনে করে। অপরের ভাষা, ধর্ম প্রভৃতিকে হেয় করার চেষ্টা করে। এমনকি যুদ্ধের মাধ্যমে নিজের শ্রেষ্ঠত্বকে অপর জাতির উপর চাপাতে চেষ্টা করে। এই উগ্র জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতার শত্রু। জার্মানির হিটলার এই উগ্র জাতীয়তাবাদের মত্ততায় বিশ্বের সভ্যতাকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছিলেন।

অর্থনৈতিক বিকৃতি

উগ্র জাতীয়তাবাদ আবার অর্থনৈতিক বিকৃতির মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদকে জন্ম দেয়। শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি নিজেদের উৎপাদিত জিনিস বিক্রি করার জন্য বিদেশের বাজার খোঁজে। বাণিজ্যের সুযােগ নিয়ে ধীরে ধীরে তারা সেই দেশের শাসনক্ষমতা দখল করে তাদের সভ্যতাকে ধ্বংস করে। ইংরেজরা এইভাবে ব্যাবসাবাণিজ্যের নাম করে ভারতে এসে ছলে বলে কৌশলে দেশের শাসনক্ষমতা দখল করে ভারতের সভ্যতাকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছিল।

এই ধরনের বিকৃত জাতীয়তাবাদ সভ্যতার পক্ষে আশীর্বাদ হতে পারে না।


রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর


প্রশ্ন ১) জাতি (Nation) কাকে বলে? ব্যাখ্যা করাে।

উত্তর: ‘জাতি’ শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হল ‘Nation’। এই ‘Nation’ শব্দটি ল্যাটিন শব্দ ‘Natio’ থেকে এসেছে। ‘Natio’ শব্দের অর্থ হল বংশগত বা জন্মগত সূত্রে আবদ্ধ জনসমষ্টি। সুতরাং যৎপত্তিগত অর্থে জাতি বলতে একই বংশ থেকে আগত এক সমাজকে বোঝায়।

জাতীয় জনসমাজের মধ্যে ঐক্য ও রাষ্ট্রনৈতিক চেতনা যখন আরা ৫৫ গভীরতর হয়, তপন জন্ম হয় জাতি বা নেশনে। নেশন শব্দটির উৎসগত অর্থ থেকে সরে গিয়ে রাজনৈতিক তাৎপর্য লাভ করেছে। জাতীয় জনসমাজের সঙ্গে জাতি পার্থক্য নির্দেশ করে রাইস বলেছেন, ভাষা-সাহিত্য, ধ্যানধারণা, রীতিনীতি, ঐতিহ্য ইত্যাদির বন্ধনে ঐক্যবদ্ধ জনসমষ্টিকে জনসমাজ বলে। অন্যদিকে রাষ্ট্রনৈতিকভাবে সংগঠিত যে জনসমাজ বহিঃশাসন থেকে মুক্ত বা মুঝ হওয়ার চেষ্টা করে তাকে জাতি বলে।

ম্যাৎসিনি উৎসগত ঐক্য ও রক্তগত চেতনাসম্পন্ন জনসমাজকে জাতি বলেছেন। প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য যে, অনেকে ‘জাতি’ ও ‘রাষ্ট্রকে’ সমার্থক বলে মনে করেন। কিন্তু এ ধারণা ঠিক নয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ওই শব্দ দুটি আলাদা অর্থ ও ব্যঞ্জন বহন করে। গিলক্রিস্ট মনে করেন, জাতীয়তাবােধে উদ্বুদ্ধ জনসমাও যখন নিজস্ব রাষ্ট্র লাভ করে তখনই সৃষ্টি হয়। জাতি। অর্থাৎ, কোনাে জনসমাজের নিজস্ব রাষ্ট্র থাকতে পারে, কিন্তু জাতীয়তাবােধের অনুভূতি না থাকলে ওই জনসমাজ জাতি হয় । আবার কোনাে জনসমষ্টি জাতীয়তাবােধে উদ্বুদ্ধ হতে পারে, কিন্তু তার নিজস্ব রাষ্ট্র না থাকলে তাকেও জাতি বলা যায় না। যেমন, ১৯৪৮ সালে ইহুদিদের জন্য স্বতন্ত্র ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পরেই ইহুদিরা একটি জাতিতে পরিণত হয়।

উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের মধ্যে ভাষা ও আচার-আচরণের মিল ছিল। তাই তারা ছিল একটি জনসমাজ। পরে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা জাগলে তারা পাকিস্তানের থেকে নিজেদের পৃথক ভাবতে শেখে। তখন তারা জাতীয় জনসমাজে পরিণত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে উঠলে তারা পরিপূর্ণ জাতিরূপে আত্মপ্রকাশ করে।


প্রশ্ন ২| জাতীয় জনসমাজের সংজ্ঞা দাও। ইহার উপাদানগুলি উল্লেখ করাে।

উত্তর: যে-কোনাে জাতির কাছে জাতীয়তাবাদ একটি আদর্শ। লয়েড (Loyed) যথার্থহবলেছেন, “Nationalism is the religion of the modern world.” অর্থাৎ জাতীয়তাবাদ হল আধুনিক জগতের ধর্ম। জাতীয়তাবাদ বা জাতির প্রতি ভালােবাসা না জন্মালে কোনাে জাতির অগ্রগতি সম্ভব নয়। এই জাতীয়তাবাদের স্বরুপ উপলদ্ধি করতে হলে জাতীয় জনসমাজ সম্পর্কে ধারণা ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।


জাতীয় জনসমাজের সংজ্ঞা

জাতীয় জনসমাজ কাকে বলে তা ব্যাখ্যা করতে গেলে জনসমাজ (People) কাকে বলে তা প্রথমে বলা প্রয়ােজন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বার্জেস বলেছেন—“যদি একই ভূখণ্ডে এমন কিছু লােক বসবাস করে যাদের মধ্যে ভাষা, সাহিত্য, আচার-আচরণ প্রভৃতির ক্ষেত্রে ঐক্য দেখা যায়, তখন তাদের বলে জনসমাজ (People)”।

এই জনসমাজের মধ্যে যদি রাজনৈতিক চেতনা জাগে, তাহলে তাদের বলা হবে জাতীয় জনসমাজ (Nationality)। রাজনৈতিক চেতনা জাগলে তারা নিজেদের মধ্যে গভীরতর ঐক্যবােধের দ্বারা আবদ্ধ হয়। অন্য জনসমাজ থেকে নিজেদের পৃথক বলে মনে করে এবং নিজেদের জন্য স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের ইচ্ছা জাগে। এই রাজনৈতিক চেতনাযুক জনসমাজকে বলে জাতীয় জনসমাজ।


জাতীয় জনসমাজের উপাদান

জাতীয় জনসমাজের উপাদানগুলিকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়, বাহ্যিক ও ভাবগত। বাহ্যিক উপাদানগুলির মধ্যে আছে,বংশগত ঐক্য, ভৌগােলিক ঐক্য, ভাষাগত ঐক্য, ধর্মগত ঐক্য, রাষ্ট্রীয় সংগঠন, অর্থনৈতিক স্বার্থ প্রভৃতি। নিম্নে এগুলি আলােচিত হল।

(ক) বংশগত বা কুলগত ঐক্য

কোনাে জনসমাজ যখন একটি বংশ থেকে এসেছে বলে মনে করে, তখন তাদের মধ্যে ঐক্য গড়ে ওঠে। এই ঐক্য গভীরতর হলে তারা জাতীয় জনসমাজে পরিণত হয়। কিন্তু এই বংশগত উপাদান অপরিহার্য নয়। যেমন, ইংরেজ ও জার্মান জাতি একই বংশ থেকে এসেছে। কিন্তু তারা ভিন্ন ভিন্ন জাতিতে পরিণত হয়েছে।

(খ) ভৌগােলিক ঐক্য

কোনাে জনসমাজ যদি দীর্ঘকাল একটি ভৌগােলিক সীমার মধ্যে বসবাস করে, তবে তাদের মধ্যে ঐক্য দেখা দেয়। একই পরিবেশের মধ্যে বসবাস করায় তাদের আচার-ব্যবহার, রীতিনীতি, চিন্তাভাবনা ও সংস্কৃতির মধ্যে একটা সমন্বয় গড়ে ওঠে। এই নৈকট্যের ফলে তারা জাতীয় জনসমাজে পরিণত

(গ) ভাষাগত ঐক্য

ভাষা ভাবের বাহন। যারা এক ভাষায় কথা বলে, একই সাহিত্য পাঠ করে তাদের চিন্তাভাবনার মধ্যে একটা ঐক্য গড়ে ওঠে যা জনসমাজ গঠনে সাহায্য করে। কিন্তু এই উপাদান অপরিহার্য নয়। ইংরেজ এবং আমেরিকানরা একই ভাষায় কথা বললেও তারা একটি জাতিতে পরিণত হয়নি।

(ঘ) ধর্মগত ঐক্য

একই ধর্মের মানুষদের মধ্যে সহজে ঐক্য গড়ে উঠতে পারে। যেমন, ধর্মের ভিত্তিতে মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন করেছে। কিন্তু এই উপাদান অপরিহার্য নয়। যেমন, একই ধর্মের মানুষ হলেও পাকিস্তান ও বাংলাদেশ পৃথক জাতিরূপে গড়ে উঠেছে।

(ঙ) রাষ্ট্রীয় সংগঠন

যদি কোনাে জনসমাজ দীর্ঘদিন ধরে একই রাষ্ট্রের অধীনে একই শাসনব্যবস্থার মধ্যে বসবাস করে, তবে তাদের মধ্যে ঐক্যবােধ জন্ম নেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন ভাষার এবং বিভিন্ন বংশের মানুষ থাকলেও দীর্ঘদিন একই শাসনব্যবস্থার অধীনে থাকার ফলে তারা একটি জাতিতে পরিণত হয়েছে।

(চ) অর্থনৈতিক স্বার্থ

অর্থনৈতিক প্রয়ােজনে জনসমাজের মধ্যে ঐক্যবােধ জাগতে পারে। রাশিয়ায় বঞ্চিত সর্বহারারা অর্থনৈতিক শোষণের অবসান ঘটাতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তুলেছে। তবে তারাও শেষ পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারেনি।

(ছ) ভাবগত ঐক্য

উপরিউক্ত উপাদানগুলি বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ হলেও কোনােটিই অপরিহার্য নয়। গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল, ভাবগত ঐক্য। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রেনা বলেছেন, জাতীয় জনসমাজের ধারণা মূলত ভাবগত। যদি কোনাে জনসমষ্টি বিশ্বাস করে যে, তাদের মধ্যে যতই’ ভাষাগত বা ধর্মগত পার্থক্য থাকুক না কেন তথাপি তারা ঐক্যবদ্ধ, এই চেতনা বা মনােভাব তাদের জাতীয় জনসমাজে পরিণত করে। কারণ, কোনাে জুনসমষ্টি যদি নিজেদের একটি জাতীয় জনসমাজ হিসাবে মনে করে তাহলে তারা জাতীয় জনসমাজে পরিণত হবে।


মূল্যায়ন

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, জাতীয় জনসমাজ গঠনে বাহ্যিক ও ভাবগত উভয় উপাদানই কাজ করে। তবে তার মধ্যে ভাবগত ঐক্য সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ভাষা বা ধর্মের পার্থক্য বড়াে কথা নয়। দেশপ্রেম বা জাতিপ্রেম হল বড়াে কথা। এই দেশপ্রেম সহস্র জীবনকে একসূত্রে বাঁধতে পারে। স্বদেশপ্রীতির এই ভাবগত বন্ধনই জাতীয় ঐক্যকে সুদৃঢ় করে। সেই কারণে অধ্যাপক গেটেল বলেছেন,—“আধুনিক রাষ্ট্রে ঐক্যের ভিত্তি হল মানসিক।” 


প্রশ্ন ৩) জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার (Right of self-determination) বলতে কী বােঝায় ? এই নীতির সপক্ষে ও বিপক্ষে কী কী যুক্তি দেওয়া হয় ? অথবা, “এক জাতি, এক রাষ্ট্র”—এই তত্ত্বটি তুমি কী সমর্থন করাে? অথবা, রাষ্ট্রের সীমা কী জাতীয় জনসমাজের সীমার সমান হওয়া উচিত?

উত্তর: জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অধিকার। কারণ এই অধিকার- চেতনা অনেক জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খলমােচনে উদ্দীপ্ত করেছে। স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের প্রেরণা দিয়েছে। নিজেদের মনােমতাে সরকার গড়ার পথ প্রশস্ত করেছে।


আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের সংজ্ঞা

জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বলতে বােঝায়—কোনাে জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের অধিকার। যখন কোনাে জনসমষ্টি ভাষা, ধর্ম, আচার-আচরণ প্রভৃতি কারণে ঐক্যবদ্ধ হয়, তখন তাকে বলে জনসমাজ (People)। এই জনসমাজের মধ্যে যখন রাজনৈতিক চেতনা জাগে অর্থাৎ স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করার ইচ্ছা জাগে, তখন তাকে বলা হয় জাতীয় জনসমাজ (Nationality)। প্রত্যেক জাতীয় জনসমাজের নিজস্ব সত্তা ও বৈশিষ্ট্য আছে। এগুলির বিকাশের জন্য তারা স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে চায়। জাতীয় জনসমাজের এই স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করার দাবি বা অধিকারকে বলে জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। প্রত্যেক জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আছে।

   বিখ্যাত ইংরেজ দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিল (0. S. Mill) এই নীতির বিশিষ্ট সমর্থক হিসাবে বলছেন, “প্রতিটি জাতীয় জনসমাজের জন্য পৃথক রাষ্ট্র থাকা প্রয়ােজন। তাই তিনি ঘােষণা করেছেন, “জাতীয় জনসমাজের সীমারেখা, রাষ্ট্রের সীমারেখার সমানুপাতিক হওয়া উচিত।”


আত্মনিয়ন্ত্রণের পক্ষে যুক্তি

উইলসন (Wilson), মিল (Mill) প্রভৃতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে সমর্থন করে নিম্নলিখিত যুক্তিগুলি দেখিয়েছেন-

প্রথমত, প্রত্যেক জাতির নিজস্ব কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য আছে। তাই এগুলির সংরক্ষণ ও বিকাশের জন্য সেই জাতিকে পৃথক রাষ্ট্র গড়তে দেওয়া উচিত।

দ্বিতীয়ত, এই অধিকার গণতান্ত্রিক। গণতন্ত্রের অর্থ হল জনগণের শাসন। কোনাে জাতি নিজস্ব রাষ্ট্র গঠন করার সুযােগ পেলে তারা নিজেদের শাসনব্যবস্থায় ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করার সুযােগ পাবে।

তৃতীয়ত, এই অধিকার স্বীকৃত হলে, পৃথিবী থেকে যুদ্ধ দুর হয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। কারণ, কোনাে জাতির স্বাধীনতার অধিকার উপেক্ষিত হলে যুদ্ধের মাধ্যমে তারা অধিকার প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হবে। কিন্তু যুদ্ধ শান্তির পথকে কণ্টকিত করে। উইলসন সাবধান করে দিয়ে বলেছেন,—“আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার একটি কথার কথা নয়, এটি অবশ্য পালনীয় কর্তব্য। রাজনীতিবিদরা একে অস্বীকার করলে নিজেদের বিপদ ডেকে আনবেন।”

চতুর্থত, একটি ফুলের বাগানে বিভিন্ন ধরনের ফুল ফুটলে যেমন বাগানের শােভা বৃদ্ধি পায়, তেমনি প্রত্যেক জাতি আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার পেয়ে আপন বৈশিষ্ট্যে বিকশিত হলে, বিশ্বসভ্যতার সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে।

পঞ্চমত, বিভিন্ন জাতি একই রাষ্ট্রে বসবাস করলে তাদের মধ্যে অবিরাম জাতিগত সংঘর্ষ লেগে থাকবে। তাতে রাষ্ট্রের মধ্যে ঐক্য থাকবে না। রাষ্ট্রের ভিত দুর্বল হবে। একটি জাতি নিয়ে রাষ্ট্র গঠিত হলে রাষ্ট্র শক্তিশালী হবে।

যষ্ঠত, প্রতিটি জাতির জন্যে পৃথক রাষ্ট্র গঠনের অধিকার একটি নীতিসম্মত অধিকার। বিভিন্ন জাতিকে জোর করে এক রাষ্ট্রে বসবাস করতে বাধ্য করা নীতিবিরােধী। বিখ্যাত দার্শনিক রাসেল (Russell) বলেছেন, “কোনাে নারীকে তার ঘৃণা করা পুরুষকে বিয়ে করতে বাধ্য করলে যা অবস্থা হবে, কোনাে জনসমাজকে অন্য জনসমাজের অধীনে থাকতে বাধ্য করলে সেই অবস্থা হবে।”


আত্মনিয়ন্ত্রণের বিপক্ষে যুক্তি

লর্ড অ্যাক্টন (Acton), কার্জন (Curzon) প্রভৃতি চিন্তাবিদগণ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে বিভিন্ন দিক দিয়ে সমালােচনা করেছেন। কারণ—

প্রথমত, এই অধিকার স্বীকৃত হলে বড়াে বড়াে রাষ্ট্র ভেঙে অনেক ছােটো ছােটো রাষ্ট্র তৈরি হবে। ছােটো দেশ সুইজারল্যান্ড ৩টি রাষ্ট্রে পরিণত হবে। ইউরােপের ২৮টি দেশ ভেঙে ৬৮টি দেশ হবে। এতে সীমানা নিয়ে আরও বেশি বিরােধ দেখা দেবে। বিশ্বশান্তি বিঘ্নিত হবে।

দ্বিতীয়ত, “এক জাতি, এক রাষ্ট্র” নীতি কার্যকর হলে, অনেক ছােটো রাষ্ট্র গড়ে উঠবে। তারা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্বনির্ভর হতে পারবে না। ফলে শক্তিশালী রাষ্ট্রের তাঁবেদার হিসাবে তাদের থাকতে হবে।

তৃতীয়ত, এই নীতিকে বাস্তবে রূপ দেওয়া খুবই শক্ত। কারণ—একই ভৌগােলিক পরিবেশে বিভিন্ন জাতি দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করায়, তারা এমনভাবে মিলেমিশে গেছে যে তাদের পৃথক করা প্রায় অসম্ভব।

চতুর্থত, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সবসময় কোনাে জাতির পক্ষে আশীর্বাদ নাও হতে পারে। লর্ড অ্যাক্টন বলেছেন, “অনুন্নত জাতি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দাবি না জানিয়ে, যদি উন্নত জাতির সঙ্গে বসবাস করে, তাহলে উন্নত জাতির সংস্পর্শে এসে তারা বরং উন্নত হতে পারবে।”

পঞ্চমত, “এক জাতি, এক রাষ্ট্র নীতি একটা জাতির পক্ষে আশীর্বাদ নাও হতে পারে। বিশেষ করে ছােটো ছােটো রাষ্ট্রগুলি অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত হতে পারে। যেমন, ভারত ও পাকিস্তান ভাগ করে পশ্চিমবঙ্গের পাটশিল্পের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে।

ষষ্ঠত, এই দাবি স্বীকৃত হলে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি জন্ম নেবে। তাতে জাতীয় সংহতি বিনষ্ট হবে। সপ্তমত, এই নীতি একবার স্বীকৃত হলে বড়াে রাষ্ট্র ভাঙতে ভাঙতে তা শেষ পর্যন্ত এমন পর্যায়ে পৌছাবে যে তার পরিণতি ভয়ংকর হতে পারে। শেষ পর্যন্ত হয়তাে দেখা যাবে, সেই ভাঙনের ঢেউ গ্রামের সীমানায় এসে পৌঁছে গেছে।


মূল্যায়ন

সুতরাং দেখা যাচ্ছে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সবসময় আশীর্বাদ নাও হতে পারে। যেখানে বৃহৎ জাতি গভীর অসন্তোষের সঙ্গে বাস করছে, সেখানে এই দাবি মেনে নেওয়া যুক্তিসংগত। তবে ক্ষুদ্র জাতির পক্ষে পৃথক রাষ্ট্র গঠন না করে যুকারী ব্যবসায় বসবাস করলে, তাদের নিরাপত্তা সুরক্ষিত হবে এবং সেইসঙ্গে স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার মাধ্যমে তাদের বিকাশ ঘটবে। 


প্রশ্ন ৪) জাতীয়তাবাদ (Nationalism)-এর সংজ্ঞা দাও। এটি কি আন্তর্জাতিকতাবাদেরপরিপন্থী? অথবা, “জাতীয়তাবাদ সভ্যতার শত্রু”—উক্তিটি পর্যালােচনা করো।

উত্তর: জাতীয়তাবাদ হল জাতির প্রতি ভালােবাসা। দেশের মানুষকে আপন করে নেবার মানসিকতা। এটি একটি মহৎ রাজনৈতিক আদর্শ। অথচ একে কেন্দ্র করে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে এর জয়গান করেছেন। আবার কেউ কেউ একে বিশ্বশান্তির পথে বাধারুপে বর্ণনা করেছেন।


জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞা

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রেনা (Renan) বলেছেন, “জাতীয়তাবাদ হল একটি ভাবগত ধারণা।” যখন কোনাে জনসমষ্টি বংশ, ভাষা, ধর্ম প্রভৃতি কারণে ঐক্যবদ্ধ হয়, তখন তাদের বলা হয় জনসমাজ। যখন এই জনসমাজের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা জাগে, তখন তাদের বলা হয় জাতীয় জনসমাজ। জাতীয় জনসমাজের মানুষেরা প্রতেকে অপরের সুখ-দুঃখে সমান অংশীদার বলে মনে করে। অন্য জনসমাজ থেকে নিজেদের পৃথক বলে ভাবতে শেখে। প্রত্যেকে নিজেদের ভাষা, ধর্ম, সাহিত্য ইত্যাদির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়। এগুলিকে সংরক্ষণ করার জন্য তাদের মধ্যে পৃথক রাষ্ট্র গঠনের ইচ্ছা জাগে। এই চেতনা তাদের ঐক্যবােধকে গভীরতর করে। জাতির প্রতি এই ভালােবাসা ও একাত্মবােধের নাম হল, -জাতীয়তাবাদ। তাই রাসেল (Russell) বলেছেন, “জাতীয়তাবাদ হল ঐক্যের অনুভূতি।”


আন্তর্জাতিকতার সংজ্ঞা

আন্তর্জাতিকতার অর্থ হল, বিশ্বের প্রতি ভালােবাসা। এটি একটি মানসিক অনুভূতি। এই অনুভূতির ফলে মানুষ নিজেকে বিশ্বের একজন নাগরিক হিসাবে মনে করে। তার চিন্তাভাবনা নিজের রাষ্ট্রের সীমানা অতিক্রম করে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্বের মানুষের কল্যাণে আত্মনিয়ােগ করতে উদ্বুদ্ধ হয়। পৃথিবীর প্রত্যেক জাতির মানুষকে আপন করে নেবার মানসিকতা জাগে। বিশ্বকবির ভাষায়,-“দূরকে করিলে নিকট বন্ধু, পরকে করিলে ভাই।”


প্রকৃত জাতীয়তাবাদ সভ্যতার শত্রু বা আন্তর্জাতিকতার বিরােধী নয়

প্রথমত, প্রকৃত জাতীয়তাবাদের নীতি হল,—নিজে বাঁচ ও অপরকে বাঁচতে দাও। এর উদ্দেশ্য হল, বিভিন্ন জাতির মধ্যে সহযােগিতার সম্পর্ক গড়ে তােলা। একমাত্র সহযােগিতার মাধ্যমে বিশ্বসভ্যতা সমৃদ্ধ হতে পারে। তাই এটি আন্তর্জাতিকতার বিরোধী নয়।

দ্বিতীয়ত, প্রকৃত জাতীয়তাবাদে অনুপ্রাণিত হলে জাতি নিজস্ব রাষ্ট্র গঠন করে নিজেদের বৈশিষ্ট্যকে বিকাশ করতে পারবে। এভাবে প্রত্যেক জাতি বিকশিত হলে বিশ্বের সভ্যতার সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে।

তৃতীয়ত, সাম্রাজ্যবাদ অপর জাতিকে শোষণ করে। বিশ্বের সভ্যতাকে ধংস করে। বিভিন্ন দেশের মানুষেরা জাতীয়তাবাদের মদ্ধে অনুপ্রাণিত হলে আন্দোলনের মাধ্যমে সাহাজ্যবাদ ধ্বসে হবে। তাতে বিশের সভ্যতা বাঁচবে।

চতুর্থত, প্রকৃত জাতীয়তাবাদ দেশের প্রতি ভালােবাসা জাগায়। দেশের প্রতি এই ভালােবাসা দেশের ঐক্য ও সংহতি গড়ে তােলে। তাতে দেশের সমৃদ্ধির পথ প্রশস্ত হয়।


বিকৃত জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতার বিরােধী এবং সভ্যতার শত্রু

বিকৃত বা উগ্র জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতার বিরোধী। এই বিকৃতি দুই ধরনের রাজনৈতিক বিকৃতি ও অর্থনৈতিক বিকৃতি।

রাজনৈতিক বিকৃতি

রাজনৈতিক বিকৃতির ফলে কোনাে জাতি নিজের বংশ, সাহিত্য, ধর্ম, ভাষা প্রভৃতিকে শ্রেষ্ঠ মনে করে। অপরের ভাষা, ধর্ম প্রভৃতিকে হেয় করার চেষ্টা করে। এমনকি যুদ্ধের মাধ্যমে নিজের শ্রেষ্ঠত্বকে অপর জাতির উপর চাপাতে চেষ্টা করে। এই উগ্র জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতার শত্রু।


অর্থনৈতিক বিকৃতি

উগ্র জাতীয়তাবাদ আবার অর্থনৈতিক বিকৃতির মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদকে জন্ম দেয়। শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি নিজেদের উৎপাদিত জিনিস বিক্রি করার জন্য বিদেশের বাজার খোঁজে। বাণিজ্যের সুযােগ নিয়ে ধীরে ধীরে তারা সেই দেশের শাসনক্ষমতা দখল করে তাদের সভ্যতাকে ধ্বংস করে। এই ধরনের বিকৃত জাতীয়তাবাদ সভ্যতার পক্ষে আশীর্বাদ হতে পারে না।


মূল্যায়ন

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, প্রকৃত জাতীয়তাবাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিকতার কোনাে বিরােধ নেই। এই জাতীয়তাবাদ সভ্যতার শত্রু নয়। বিকৃত জাতীয়তাবাদের সঙ্গে বিরােধ আছে। অথচ বর্তমানে বিকৃত এবং উগ্র জাতীয়তাবাদ প্রবল হয়ে দাঁড়িয়েছে। নয়া-উপনিবেশবাদের ভদ্রবেশী পােশাক পরে তারা নতুন কৌশলে শােষণ চালিয়ে যাচ্ছে। এই অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে গেলে উগ্র জাতীয়তাবাদের বিষকে নির্মূল করতে হবে। আন্তর্জাতিকতাবােধে উদ্বুদ্ধ হতে হবে। বিভিন্ন জাতির মধ্যে সহযােগিতা বৃদ্ধি করতে হবে। তা না হলে বিশ্বসভ্যতা ধ্বংস হবে।


প্রশ্ন ৫) ভারতকে কি একটি জাতি বলা যায় ?

উত্তর: ভারত একটি জাতি কিনা সে প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলে প্রথমে জাতি কাকে বলে তা জানা প্রয়োজন। জাতি বলতে বােঝায়,–এক রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন জনসমাজ যারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করে। তাদের জাতি বলা হয়। অর্থাৎ জাতি গঠনের প্রধান উপাদান হল ঐক্যবদ্ধতা। সেদিক থেকে ভারত একটি জাতি কিনা সে বিষয়ে বিতর্কের সূচনা হয়েছে।


ভারত একটি জাতি নয়

ভারতের অধিবাসীদের একটি জাতি বলা যাবে কিনা এ বিষয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তাদের বক্তব্য হল বংশগত ঐক্য, ভাষাগত ঐক্য, ধর্মগত ঐক্য, ভৌগােলিক ঐক্য, রাষ্ট্রীয় সংগঠন, অর্থনৈতিক স্বার্থ, ভাবগত ঐক্য প্রভৃতি উপাদান জাতি গঠনে সাহায্য করে। কিন্তু ভারতে এগুলির যথেষ্ট অভাব আছে।

ভারতীয়রা বিভিন্ন বংশ থেকে এসেছে। তারা বাংলা, হিন্দি, তামিল, ইংরেজি প্রভৃতি বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। এই ভাষাগত পার্থক্য এত গভীর যে তাদের ঐক্যবদ্ধ করা বিরাট সমস্যা। এখানে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন প্রভৃতি বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বাস করে। বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে সদ্ভাব নেই। মন্দির মসজিদকে কেন্দ্র করে তা প্রমাণিত হয়েছে। ভারতীয় জনগণের মধ্যে ভৌগােলিক ঐক্যের অভাব। সুদুর পাহাড়ি অঞ্চলে যারা বাস করে তাদের সঙ্গে সমতলভূমির মানুষদের নৈকট্য খুঁজে পাওয়া যাবে । তা ছাড়া, আচার-আচরণ, পূজাপার্বন প্রভৃতি ক্ষেত্রেও জনগণের মধ্যে পার্থক্য দেখা যায়।

এই পার্থক্যের গভীরতার জন্য ভারতীয়দের একজাতি বলা যায় না। জাতীয়তাবােধের অভাবে ভাষাগত দাঙ্গা, জাতপাতের লড়াই দেখা যাচ্ছে। এক জাতি, এক প্রাণ হলে এভাবে সংহতি বিপন্ন হত না।


ভারত একটি জাতি

কিন্তু একথা আজ স্বীকৃত যে, ভাষা, ধর্ম প্রভৃতি উপাদান জাতি গঠনে অপরিহার্য নয়। সুইজারল্যান্ডের মানুষ বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। তবুও তারা এক জাতি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ বিভিন্ন বংশ থেকে এসেছে। তবুও তারা ঐক্যবদ্ধ একটি জাতি।

প্রকৃতপক্ষে জাতীয়তাবােধ একটি ভাবগত ধারণা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রেনা (Renan) বলেছেন,—The idea of Nationality is essentially spiritual in Character. অর্থাৎ জাতীয় জনসমাজের ধারণা মূলত ভাবগত। যদি কোনাে জনসমষ্টি মনে করে তাদের মধ্যে ভাষাগত, ধর্মগত প্রভৃতি ক্ষেত্রে যতই পার্থক্য থাকুক না কেন, তারা ঐক্যবদ্ধ, তাহলে তারা এক জাতিতে পরিণত হতে পারে।

ভারতের ক্ষেত্রে একথা প্রযােজ্য। এখানে ভাষাগত, ধর্মগত প্রভৃতি ক্ষেত্রে পার্থক্য আছে সত্য। তা সত্ত্বেও ভারতবাসী ভাবগত কারণে ঐক্যবদ্ধ। তাই শক, হুণ দল, পাঠান, মােগল ভারতের দেহে লীন হয়ে ভারতীয় হিসাবে পরিচিত হয়েছে। পাঞ্জাব, গুজরাট, মারাঠা, উৎকল ও বঙ্গের অধিবাসীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে। স্বাধীনতার পরে বিদেশিরা ভারত আক্রমণ করেছে। ভারতবাসীরা ঐক্যবদ্ধভাবে তার মােকাবিলা করেছে। ভারতবাসীর দেশপ্রেম ও ঐক্যবদ্ধতা কার্গিল যুদ্ধে প্রমাণিত হয়েছে। এই দেশপ্রেম ও ঐক্যচেতনা ভারতের জাতীয়তাবাদকে শক্তিশালী করেছে।

একথা সত্য, ভারতের জাতীয় সংহতি আজ বিপন্ন। সাম্প্রদায়িকতা ও বিচ্ছিন্নতাবাদের অশুভ শক্তি আত্মপ্রকাশ করেছে। তবে মুষ্টিমেয় স্বার্থান্বেষী গােষ্ঠী বিদেশি মদত পেয়ে একাজ করেছে। ভারতের জাতীয়তাবাদী মানুষ এই শক্তির বিরুদ্ধে সােচ্চার হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় ভারত একটি জাতি।


প্রশ্ন ৬) আন্তর্জাতিকতা কাকে বলে? এর প্রয়ােজনীয়তা ও গুরুত্ব আলােচনা করাে।

উত্তর: আন্তর্জাতিকতার সংজ্ঞা সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা একমত হতে পারেননি। কেউ কেউ বলেছেন,—আন্তর্জাতিকতা বলতে বােঝায় জাতীয় রাষ্ট্রের পরিবর্তে বিশ্বরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা।

এই সংজ্ঞা গ্রহণযােগ্য নয়। কারণ, অনেকে মনে করেন, প্রত্যেক জাতির মধ্যে বিশেষ গুণ আছে। সেই গুণগুলি বিকশিত হলে বিশ্বের সভ্যতা সমৃদ্ধ হবে। তাই জিমার্ন বলেছেন,—“জাতীয়তাবাদের পথ ধরে আন্তর্জাতিকতায় পৌঁছানাে যায়।”

তাই বিশ্বসভ্যতার প্রয়ােজনে প্রকৃত জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিশ্বের মানুষকে ভালােবাসতে হবে। এই ভালােবাসার নাম হল আন্তর্জাতিকতা। এটি একটি মানসিক অনুভূতি। এই অনুভূতির ফলে মানুষ নিজেকে বিশ্বের একজন নাগরিক হিসাবে মনে করে। তাদের সুখে-দুঃখে সমান অংশীদার হিসাবে ভাবতে শেখে। “নিজে বাঁচ এবং অপরকে বাঁচতে দাও”—এই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়।

এই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে প্রত্যেকের মধ্যে অপর জাতির মানুষকে আপন করে নেবার মানসিকতা জাগে। বিশ্বকবির ভাষায়, “দূরকে করিলে নিকট বন্ধু, পরকে করিলে ভাই”। এইভাবে বিশ্বের সবাইকে আপন করে নেবার চিন্তাভাবনার নাম হল আন্তর্জাতিকতা।


আন্তর্জাতিকতার প্রয়ােজনীয়তা ও গুরুত্ব

আন্তর্জাতিকতার মূল কথাই হল ‘ নিজে বাঁচ এবং অপরকে বাঁচতে দাও’ (Live and let live)। এই ধারণা জাতিকে স্বার্থপরতা, সংকীর্ণতা ও অহমিকা হতে মুক্ত করবে। বর্তমানে আন্তর্জাতিকতার আদর্শ মানবসমাজ ও সভ্যতার অস্তিত্বের জন্যই প্রয়ােজন হয়ে পড়েছে। নিম্নে এগুলি আলােচিত হল।

মানবসমাজ ও সভ্যতার অস্তিত্ব রক্ষায়

বর্তমান যুগে কোনাে জাতির পক্ষে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দাবি করা সম্ভব নয়, আত্মনির্ভরশীলতার মিথ্যা দন্ত কোনাে জাতির জীবনে প্রাধান্য লাভ করে না। আত্মকেন্দ্রিকতা জাতির জীবনে বিনাশের সম্ভাবনা বহন করে।

পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের সঙ্গে সহজ যােগাযােগ ব্যবস্থা

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার অভাবনীয় উন্নতির ফলে ভৌগােলিক সীমারেখা আজ দূর হয়ে গিয়েছে। পৃথিবীর এক প্রান্তের সঙ্গে অপর প্রান্তের সহজ যােগাযােগ এক দেশের মানুষের সঙ্গে অন্য দেশের মানুষের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।

ব্যাবসাবাণিজ্য, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নির্ভরতা

ব্যাবসাবাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক জীবনের ক্ষেত্রেও বিভিন্ন জাতি পরস্পরের ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও এককভাবে কোনাে জাতি সম্পূর্ণ নিজস্ব চাহিদা পূরণ করতে পারে না, তাকে অন্যের সহযােগিতার ওপর নির্ভর করতে হয়। , ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও সহযােগিতার বন্ধনে আবদ্ধ আদর্শ বিশ্বসভ্যতা যুগে যুগে মণীষীগণ মানবজাতির ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও সহযােগিতার বন্ধনে আবদ্ধ এক আদর্শ বিশ্ব সভ্যতার কল্পনা করেছেন। সেই কবি-কল্পনা বর্তমান যুগে অধিকতর বাস্তবতার সম্ভাবনায় উজ্জ্বল হয়েছে। সবার ওপরে মানুষ সত্য, তাহার ওপরে নাই’—এই মহান আদর্শ জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রের সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে এক নতুন পৃথিবীর বাণী বহন করে।

উগ্র জাতীয়তাবাদ রােধ

দুটি বিশ্বযুদ্ধে মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে ধ্বংসের বীভৎস লীল, নির্বিচার পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড, চরম মানবতাবিরােধী কার্যকলাপ। জাতির নামে, জাতীয় রাষ্ট্রের নামে উগ্র জাতীয়তাবাদ মানুষের প্রতি মানুষের বিদ্বেষ, হিংসাকে প্রশ্রয় দিয়ে আদিম আরণ্যক পরিবেশের ছবি তুলে ধরেছে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক আদর্শই মানুষের সম্মুখে নতুন আশার আলাে দেখাতে পারে।


মূল্যায়ন

বর্তমান পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিকতার কোনাে বিকল্প কল্পনা করা যায় না। উৎ বর্তমান পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিকতার কোনাে বিকল্প কল্পনা করা যায় না। উগ্র জাতীয়তাবাদের আড়ালে পুঁজিবাদ সমগ্র বিশ্বের আবহাওয়াকে বিষাক্ত করে তুলেছে। পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণের প্রতিযােগিতা, নক্ষত্রযুদ্ধের মহড়া, সমাজতান্ত্রিক ও পুঁজিবাদী শিবিরের দ্বন্দ্ব সমগ্র বিশ্বসভ্যতাকে এক ধ্বংসের মুখােমুখী দাঁড় করিয়েছে। তা ছাড়া বর্তমানের যুদ্ধ হল সর্বাত্মক যুদ্ধ, তাতে সামরিক, বেসামরিক কোনাে ভেদ নেই। সাম্প্রতিক উপসাগরীয় যুদ্ধের ভয়াবহতা, আফগানিস্তান ও ইরাকের ওপর নির্বিচার অত্যাধুনিক অস্ত্রের ব্যবহার প্রমাণ করেছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির নয়া উপনিবেশবাদী কৌশল আন্তর্জাতিকতা ও মানবতার সবচেয়ে বড় শত্রু। পৃথিবীর ইতিহাসে মানবসভ্যতা এত বিরাট ও তীব্র সংকটের সম্মুখীন কখনও হয়নি। রাসেল বলেছেন, যুদ্ধকে বিনাশ করতে না পারলে যুদ্ধ মানুষের বিনাশ সাধন করবে। অধ্যাপক ল্যাস্কির ভাষায় বলা যায়, আন্তর্জাতিক দৃষ্টিতে চিন্তা করতে না পারলে আমরা বাঁচতে পারব না। সুতরাং এই জটিল ও সংকটময় পরিস্থিতিতে মানুষের বাঁচবার একমাত্র পথই হল আন্তর্জাতিকতার পথ।


Download জাতীয়তাবাদ, জাতি ও রাষ্ট্র - Nationality Nation and State PDF


File Details:-

File Name:- জাতীয়তাবাদ, জাতি ও রাষ্ট্র - Nationality Nation and State [www.gksolves.com]
File Format:-PDF
Quality:- High
File Size:-  5 Mb
File Location:- Google Drive

Click Here to Download


আরও পড়ুন:




Others Important Link

Syllabus Link: Click Here

Questions Paper Link: Click Here

Admit Card Link: Click Here

Result Link: Click Here

Latest Job: Click Here

Age Calculator: Click Here


ঘোষণা: বিনামূল্যে আমাদের দেওয়া নোটস, সাজেশান, প্রশ্ন উত্তর ইত্যাদি স্টাডি ম্যাটেরিয়াল PDF এবং ভিডিও ক্লাস ভালো লাগলে, আমাদের এই পোস্টের লিংক আপনার বন্ধুদের ফেসবুকWhatsApp এ শেয়ার করে তাদের পড়ার সুযোগ করে দিন।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.