শিবাজীর শাসন ব্যবস্থার বিবরণ: Shivaji Administrative System
শিবাজীর শাসন ব্যবস্থার বিবরণ: Shivaji Administrative System
প্রশ্ন: শিবাজীর শাসন ব্যবস্থার বিবরণ দাও (Point out the chief features of Shivaji's administrative system)
উত্তর: সুচতুর ও সুদক্ষ যােদ্ধা শিবাজীর তুলনায় বলিষ্ঠ ও উদার প্রশাসক শিবাজীর কৃতিত্ব কোনাে অংশে কম ছিল না। রাজত্বের অধিকাংশ সময়ই তাকে যুদ্ধবিগ্রহে কাটাতে হয়েছে। আচার্য যদুনাথ সরকার শিবাজীর রাষ্ট্রকে ‘যুদ্ধ-রাষ্ট্র’ (war state) বলে অভিহিত করেও কিন্তু শিবাজীর শাসনপ্রতিভার মৌলিকত্বের কথা স্বীকার করেছেন। এ ব্যাপারে তাঁর ভূমিকা ছিল এক অসাধারণ সমন্বয়কারীর। মুঘলযুগে প্রচলিত শাসনকাঠামাের সাথে প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যের সুসমন্বয় ঘটিয়ে এক স্বতন্ত্র ও কার্যকরী প্রজাহিতৈষী শাসনকাঠামাে তিনি প্রবর্তন করতে সক্ষম হন। সর্বভারতীয় রাষ্ট্রগঠনের তুলনায় মারাঠা জাতীয় রাষ্ট্র গঠনই ছিল শিবাজীর প্রধান লক্ষ্য। এইজন্য তিনি তার অধিকৃত অঞ্চলে দু-ধরনের প্রশাসন চালু করেন। যে অঞ্চল সরাসরি তার শাসনাধীনে ছিল, তার নাম ' স্বরাজ্য '। এ ছাড়াও শিবাজীর বশ্যতা স্বীকার করে নিয়ে কিছু অঞ্চল তাকে নিয়মিত কর প্রদান করত। একে বলা হত ' মালকাগিরি '। এই দ্বিতীয় শ্রেণির অঞ্চলে তিনি কখনােই প্রত্যক্ষ শাসন বিস্তৃত করতে চাননি।
❏ মন্ত্রিপরিষদ: শিবাজীর শাসনব্যবস্থায় রাজা ছিলেন সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। অষ্টপ্রধান নামক আটজন মন্ত্রীর এক পরিষদ বিভিন্ন বিষয়ে শিবাজীকে সহায়তা করতেন। এঁরা হলেন-
(১) মুখ্য প্রধান বা পেশােয়া, যিনি ছিলেন মন্ত্রিপরিষদের। প্রধান এবং সামগ্রিকভাবে রাজ্যের সব বিভাগের তত্ত্বাবধান করতেন।
(২) অমাত্য ছিলেন অর্থমন্ত্রী, রাজ্যের আয়-ব্যয়ের হিসাব তিনি রাখতেন।
(৩) ওয়াকিনবিস রাজার প্রাত্যহিক কাজকর্ম ও দরবারের ঘটনাবলী নথিবদ্ধ করে রাখতেন।
(৪) সচিব বা সর্বনিম্ন সরকারি নথিপত্র লিপিবদ্ধ করতেন।
(৫) সুমন্ত বা দাবীর -এর কাজ ছিল রাষ্ট্রের সাথে যােগাযােগ রক্ষা করা।
(৬) পণ্ডিত রাও বা দানাধ্যক্ষ ধর্ম বিষয়ে ও সরকারি দান-ক্ষয়রাতের বিষয়ে পরামর্শ দিতেন।
(৭) সেনাপতি ছিলেন সৈন্যবাহিনীর প্রধান এবং
(৮) ন্যায়াধীশ বা কাজি-উল-কাজাৎ বিচারবিভাগের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন। ন্যায়াধীশ এবং পণ্ডিতরা ছাড়াও অন্যান্য মন্ত্রীদের সামরিক কর্তব্য পালন করতে হত। অষ্টপ্রধানদের ' রাজমণ্ডল ' বলেও অভিহিত করা হত।
❏ কর্মী নিয়োেগ পদ্ধতি: সরকারি কর্মচারী নিয়ােগের দায়িত্ব ছিল শিবাজীর নিজের হাতে। এ বিষয়ে তিনি খুব সচেতন ছিলেন। সামন্ত-প্রভুদের ক্ষমতা খর্ব করার জন্য তিনি বংশানুক্রমিক জায়গির-প্রথা তুলে দেন এবং জেলায় জেলায় সরকারি কর্মচারী নিযুক্ত করেন। ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধ করার জন্য এইসব নিয়ােগ বদলিযােগ্য করা হয়। উপরিলিখিত আট মন্ত্রী ছাড়া চিটনিস, মজুমদার, সুবনিস, পাটনিস, দেওয়ান প্রভৃতি বহুশ্রেণির কর্মচারী নিযুক্ত করা হয়।
❏ শাসনতান্ত্রিক বিভাগ: শিবাজী তার স্বরাজ্যকে ১৪ টি প্রান্ত বা প্রদেশে বিভক্ত করেন। এর নীচে পরপর ছিল পরগনা বা তরফ এবং গ্রাম। প্রান্তের শাসনকর্তাকে বলা হত ‘মামলাতদার’। এঁকে সাহায্য করতেন ' কম্ভিসদার ' নামক কর্মচারী। প্রান্তগুলিতেও আটজনের একটি করে পরামর্শদাতা সভা থাকত। প্রতিটি প্রান্ত একাধিক তরফে বিভক্ত ছিল। তরফের শাসনকর্তাকে বলা হত কারকুন বা হাবিলদার। তরফগুলি আবার বহুসংখ্যক গ্রামে বিভক্ত ছিল। গ্রামগুলি ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। শিবাজী গ্রামগুলির স্বশাসন অধিকারে হস্তক্ষেপ করেননি। গ্রাম-সমিতিগুলিই গ্রামের শাসন পরিচালনা করত। সরকার ও গ্রামের মধ্যে সমন্বয় রক্ষা করত প্যাটেল নামক কর্মচারী। গ্রাম-সমিতিই প্যাটেল নির্বাচিত করত।
❏ রাজস্ব ব্যবস্থা: শিবাজী আহম্মদনগরের মালিক অম্বরের প্রথাকে অনুসরণ করেই তার ভূমিরাজস্ব নীতি ঠিক করেন। রাজ্যের সমস্ত জমি জরিপ করে উৎপন্ন ফসলের শতকরা ত্রিশ ভাগ রাজস্ব ধার্য হয়। পরে এই পরিমাণ বাড়িয়ে শতকরা চল্লিশ ভাগ করা হয়। শস্যে অথবা নগদ অর্থ রাজস্ব দেওয়া যেত। ফ্রায়ার (Fryer) শিবাজীর রাজস্বব্যবস্থাকে ‘শােষণের নামান্তর’ বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু এ কথা ঠিক নয়। কারণ রাজস্বের এই হার পূর্বেও প্রচলিত ছিল। তা ছাড়া রাজস্ব আদায়ের জন্য শিবাজী অত্যাচার করতেন, এ প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অধিকন্তু কৃষির উন্নতির জন্য তিনি সরকারি কোষাগার থেকে ঋণদানেরও ব্যবস্থা করেছিলেন।
❏ চৌথ ও সরদেশমুখী: শিবাজী প্রতিবেশী অঞ্চল, মুঘল-অধিকৃত রাজ্য ও বিজাপুরের কোনাে কোনাে অঞ্চল থেকে ‘চৌথ’ ও ‘সরদেশমুখী’ নামে দু-প্রকার কর আদায় করতেন। চৌথ ছিল রাজস্বের এক-চতুর্থাংশ এবং সরদেশমুখী ছিল এক দশমাংশ। এই করকে কোনাে কোনাে ঐতিহাসিক ' রক্ষা-কর ' বলে অভিহিত করেছেন। কারণ মারাঠা বর্গী-আক্রমণের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার শর্তে প্রতিবেশী রাজ্য এই কর প্রদান করত। পণ্ডিতেরা এই কর আদায়ের নিন্দা করেছেন। কারণ প্রতিবেশী রাজ্যে এই ধরনের কর আদায় নীতিগতভাবে সমর্থনযােগ্য নয়।
এ ছাড়া বণিকদের কাছ থেকে আদায়ীকৃত ‘মহাতরফা এবং বিভিন্ন বাজারে ক্রয় বিক্রয়ের উপর নির্ধারিত জাকাৎ’ নামক শুল্ক থেকেও শিবাজী কিছু অর্থ সংগ্রহ করতেন।
❏ সামরিক সংগঠন: শিবাজীর বিশেষ কৃতিত্ব হল তার সামরিক সংগঠন। সাধারণ পার্বত্য মাওয়ালী সৈন্যবাহিনী নিয়ে জীবন শুরু করলেও অল্প সময়ের মধ্যে তিনি এক সুবিশাল, সুসংগঠিত ও সুশিক্ষিত সেনাবাহিনী গড়ে তােলেন। তার সেনাবাহিনীতে একটি পদাতিকবাহিনী থাকলেও, আসল শক্তি ছিল তার অশ্বারােহীবাহিনী। পার্বত্য অঞ্চলে এবং গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধের কারণ এই দ্রুতগামী অশ্বারােহীবাহিনী ছিল অপরিহার্য। মারাঠা অশ্বারােহীবাহিনী ' পাগা বা বর্গী ' এবং ' শিলাদার ' -এই দু'ভাগে বিভক্ত ছিল। বর্গীরা ছিল সরকারি স্থায়ী সৈন্য। এদের অশ্ব, অস্ত্র, পােশাক বিভক্ত ছিল। এদের অশ্ব, পােশাক ও নিয়মিত বেতন সরকার থেকে দেওয়া হত। কিন্তু শিলাদাররা ছিল ভাড়াটে সৈন্য। এরা নিজেরাই অশ্ব ও অস্ত্র সংগ্রহ করত। যুদ্ধের প্রয়ােজনে এরা নগদ অর্থের বিনিময়ে সরকারকে সাহায্য করত। ' সভাসদ বখর ' থেকে শিবাজীর একটি নৌবাহিনীর কথা জানা যায়। ছােটো-বড়াে নৌকো ও যুদ্ধজাহাজ মিলিয়ে এই বাহিনীতে প্রায় চারশাে জলযান ছিল। এ ছাড়া তার অধীনে প্রায় ২৫০ টি দুর্গ ছিল। শিবাজীর সামরিক সংগঠনে দুর্গগুলির বিশেষ ভূমিকা ছিল। হাবিলদার, সীশ ও সর্নোবৎ নামক তিনজন কর্মচারীর উপর প্রতিটি দুর্গের দায়িত্ব থাকত। শিবাজীর সামরিক সংগঠনের বৈশিষ্ট্য ছিল এর ঐক্যবােধ ও কঠোর শৃঙ্খলা। এখানে দুর্নীতির কোনাে স্থান ছিল না। সেনাশিবিরে স্ত্রীলােকের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। পরাজিত শত্রুর উপর অত্যাচার বা গবাদি পশুহত্যা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ছিল। সেনারা কখনও ধর্মস্থানে হস্তক্ষেপ করত না।
❏ বিচারব্যবস্থা: শিবাজীর শাসনকালে বিচারব্যবস্থা তেমন উন্নত ছিল না। তিনি কোনাে স্থায়ী বিচারালয় স্থাপন করেননি। গ্রামের বিচার করত গ্রাম পঞ্চায়েতগুলি। ফৌজদারি বিচারের ভার ছিল গ্রাম-মুখিয়া বা প্যাটেল -এর হাতে। আপিলবিচার হত ‘হাজার মজলিশ’ নামক সভায়। ন্যায়াধীশ আপিলবিচার নিষ্পত্তি করতেন।
❏ মূল্যায়ন: গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে শিবাজীর শাসনব্যবস্থার কয়েকটি সহজাত ত্রুটি ধরা পড়ে।
প্রথমত, এই শাসনব্যবস্থায় মন্ত্রিপরিষদ প্রত্যক্ষভাবে শাসনকার্যে যুক্ত না-থেকে মূলত পরামর্শদাতার কাজ করত। এর ফলে শাসনব্যবস্থা পুরােপুরি রাজার ব্যক্তিগত দক্ষতার উপর নির্ভরশীল ছিল। তাই শিবাজীর পরে তার দুর্বল বংশধরদের সময়ে এই ব্যবস্থা কার্যকরী হয়নি।
দ্বিতীয়ত, তিনি ব্রাহ্মণদের অতিরিক্ত প্রাধান্য দিয়ে মহাভুল করেন। তার মন্ত্রিসভার ৮ জন মন্ত্রীই ছিলেন ব্রাহ্মণ। এদের হাতে প্রচুর ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়ে রা র সংহতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তৃতীয়ত, ৬ জন মন্ত্রীকেই বেসামরিক ও সামরিক উভয় দায়িত্ব পালন করতে হত। ফলে এঁরা ক্ষমতালােভী হয়ে পড়েন। পরবর্তীকালে পেশােয়াই মারাঠা রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রধান হয়ে পড়েন।
চতুর্থত, তার রাজস্বব্যবস্থা শােষণের নামান্তর ছিল বলে অনেকের ধারণা। তার রাজস্ব কর্মচারীরা ছিল স্বার্থপর ও নিষ্ঠুর। তা ছাড়া ‘চৌথ’ ও ‘সরদেশমুখ’ নামক জবরদস্তি কর আদায়কে অধিকাংশ ঐতিহাসিক সমর্থন করেননি।
পঞ্চমত, তিনি জায়গির - প্রথা তুলে দিতে চাইলেও, তার কুফল থেকে মুক্তি পাননি। পরবর্তীকালে এটি পুনঃপ্রবর্তিত হয়ে মারাঠাদের পঞ্চরাজ্যের জন্ম দেয়।
ষষ্ঠত, জাতীয় সংহতি সুদৃঢ় করার জন্য কোনাে সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা শিবাজী নিতে পারেননি।
আমাদের কথা: যদি কোনো প্রশ্নের উত্তর বা বানান ভুল থাকে, এই ভুল আমাদের অনিচ্ছাকৃত এর জন্য আমরা ক্ষমা প্রার্থী। সঠিকটা অবশ্যই কমেন্ট করে জানান আমরা পরবর্তী ক্ষেত্রে আপডেট করে দেব।
Please do not share any spam link in the comment box